কলকাতার রাস্তায় চলে এশিয়ার প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম, সরকারি সদিচ্ছার অভাবে যা বিলুপ্ত প্রায়
কল্লোল মজুমদার
১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শহর কলকাতায় ট্রাম চালু হয় শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত। সেদিনের ঘোড়ায় টানা ট্রাম মূলতঃ পণ্য পরিবহনের জন্য শুরু করা হলেও প্রথম দিন থেকেই তা যাত্রী পরিবহন করে। এরপর ১৮৮০ সালে লন্ডনে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি লিমিটেড গঠিত ও নিবন্ধিকৃত হয়।
এশিয়ার প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম চালু হয় ১৯০০ সালে কলকাতার ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর। দেশের স্বাধীনতা লাভের পর লাভজনক ট্রাম কোম্পানিকে সরকারের অধিগ্রহণের দাবি জানান শ্রমিক সংগঠন। বিধানসভার মধ্যে ট্রাম অধিগ্রহণের দাবির পক্ষে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামপন্থী বিধায়করা একই দাবি জানাতে থাকেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় ট্রাম কোম্পানির মালিকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন ১৯৫১ সালে। যা ট্রামওয়েজ অ্যাক্ট ১৯৫১ নামে পরিচিত।
এই আইন বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্রামওয়েজের সকল স্বত্বাধিকার ১লা জুন ১৯৭২ বা তার দুই বছরের নোটিশে অধিগ্রহণ করার অধিকারী হয়। এই আইন বলে ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকারের সময় গঠিত হয় ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি (১৯৭৮) লিমিটেড (ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি বা CTC ), পশ্চিমবঙ্গ সরকার অধিগৃহীত একটি সংস্থা।
অধিগ্রহণ তো হল, কিন্তু সিটিসি তখন টানা দুই দশক ধরে বিনিয়োগহীন এক সংস্থা! তখন দরকার নতুন বিনিয়োগ। বিশ্বব্যাঙ্ক ও রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের সাহায্যে ৪২ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ সংস্থায় আসে। ১৬৯টি নতুন ট্রাম কেনার সঙ্গে ২৫টি গাড়ি সংস্থায় তৈরি হয়। লাইন, সাব-স্টেশন, ওভারে হেড তার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সংস্থার কাজে গতি আসে। ট্রাম পরিষেবা বাড়ে, যাত্রী পরিষেবার গতি বাড়ে।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় প্রতি বছর ট্রামের আধুনিকীকরণের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হত। বামফ্রন্ট পরিচালিত কলকাতা কর্পোরেশনও ট্রাম লাইন রক্ষার্থে যথাযথ ভূমিকা পালনের চেষ্টা করত। আবার উল্টোদিকে তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ট্রাম রাস্তাগুলিতে বোর্ড টাঙিয়ে ঘোষণা করেছিল-রাস্তার ভগ্নদশার জন্য কর্পোরেশন দায়ী না, দায়ী ট্রাম! ২০০৭-০৮ সালে কলকাতার ট্রাম রাস্তা সারানো জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয় রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে। ২০০৫-১০ পর্বে বামফ্রন্টের পুরবোর্ড কলকাতার ট্রামের উন্নয়নে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়। ফলশ্রুতিতে ট্রাম রাস্তা কংক্রিটের হয়। রাস্তার গতি বাড়ে। চালু করা হয় আধুনিক ট্রাম। এসি ট্রামও।
২০১১ সালে কলকাতায় ৩৭টি রুটে ট্রাম চালানো হত। ২২০টি গাড়ি মজুত ছিল, যার মধ্যে প্রতিদিন চলত ১০০-১১০ টি। ৭০ থেকে ৭৫ হাজার যাত্রী ছিল প্রতিদিন। প্রায় ৭ হাজার ৩০০ স্থায়ী কর্মী ছিলেন তখন।
২০১১ সালের মে মাসে রাজ্য সরকারের বদল ঘটে। নতুন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠনের দু’দিনের মধ্যে জোকা-বেহালা ট্রাম রুট বন্ধ করা এবং এক রাতের মধ্যে ট্রাম লাইন তুলে ফেলার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ ঘটে বর্তমান রাজ্য সরকার ট্রাম সম্পর্কে কী পথে আগামীদিনে চলবে।
এখন এই ২০২৩ সালে মাত্র দুটি রুটে ট্রাম চালানো হয়। মজুত গাড়ির সংখ্যা মাত্র কুড়িটি, যার মধ্যে প্রতিদিন চলে মাত্র ১১-১২টি! যাত্রী সংখ্যা খুব স্বাভাবিকভাবেই কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩-৫ হাজার-এ! স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা কমেছে দ্রুত হারে! অথচ এখনও প্রায় ৭৫ থেকে ৮০টি ট্রাম এমন অবস্থায় আছে, একটু সদিচ্ছা থাকলেই সেগুলিকে নিয়মিত চালানো সম্ভব। কিন্তু করবে কে?
বর্তমান রাজ্য সরকার প্রকাশ্যে বলছে ট্রামের লাইনের উপর পিচ ঢেলে দেওয়া হবে। বিভিন্ন রুটে ট্রামের ওভার হেড তার খুলে নেওয়া হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে ৩৭টি ট্রামকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত এ মাসেই প্রশাসন নিয়েছে! ট্রাম কমানো এবং তুলে দেওয়ার পিছনে সরকারের যুক্তি কী?
১. শ্লথ গতির যান। যানজট করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে গতি বাড়ানোর জন্য সারা বিশ্বে ট্রামের আধুনিকীকরণ হয়েছে (আমাদের এখানেও কিছুটা হয়েছিল বামফ্রন্টের পুরবোর্ডের আমলে), পৃথিবীর বড় বড় শহরে ট্রাম চলছে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, হংকং, টোকিও, মেলবোর্ন, ওয়াসিংটন ডিসি, প্যারিস, বার্লিন সর্বত্র ট্রাম চলছে, যাত্রীও বাড়ছে প্রতিদিন। তবে এখানে হবে না কেন?
২. যানজটের কারণ ট্রাম!
বাইপাসে, যাদবপুরে, বেলেঘাটায়, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে তো ট্রাম চলে না, তাহলে এই সব জায়গায় যানজট কেন? কলকাতায় অনেক রাস্তায় ট্রাম বন্ধ হয়েছে তাতে কি যানজট কমেছে?
( প্রকাশিত মতামতের দায়িত্ব নিবন্ধকারের।)
নিউজ ফ্রন্ট বাংলার অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন টি ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন।