এক্সক্লুসিভ কপি
অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ
একশো বছরে বহু বঙ্গ ফুটবল তারকার জন্ম হয়েছে ডার্বি থেকে। পরে তাঁরা হয়ে উঠেছেন আরও বহু ডার্বির তারকা। বাংলার এমনই পাঁচজন ফুটবল তারকাকে নিয়ে এই প্রতিবেদন। এই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীরা অনেকেই এঁদের খেলা দেখেননি। কিন্তু এঁদের কথা শুনেছেন। মাঠে কেমন ছিলেন তাঁরা, তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
সুব্রত ভট্টাচার্য (মোহনবাগান ১৯৭৪-১৯৯০)
টানা ১৭ বছর খেলেছেন সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে। কখনও ক্লাব বদল করেননি। তাই তাঁকে মোহনবাগানের ঘরের ছেলে বলে ডাকা হয় এখনও। পরবর্তীকালে মোহনবাগানের কোচও ছিলেন। এই ভূমিকায় দু’বার ক্লাবকে জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়নও করিয়েছেন। ১৯৭৭-এ মোহনবাগানের অধিনায়ক নির্বাচিত হন সুব্রত, কলকাতা ময়দানে যিনি ‘বাবলু’ বলেই বেশি পরিচিত। সেই বছরই কিংবদন্তি পেলের দল কসমস যখন কলকাতায় খেলতে আসে, তখন তাঁর নেতৃত্বেই ২-২ ড্র করে মোহনবাগান এবং অধিনায়কত্ব পেয়ে দলকে ভারতীয় ফুটবলের ত্রিমুকুট (ডুরান্ড কাপ, রোভার্স কাপ ও আইএফএ শিল্ড) জিততে সাহায্য করেন তিনি। মোহনবাগানের হয়ে প্রায় সাড়ে আটশো ম্যাচ খেলেছিলেন সুব্রত। যার মধ্যে প্রায় ৫০টি ডার্বিও ছিল।
ডিফেন্ডার হলেও মোহনবাগানের জার্সি গায়ে ৪১টি গোল করেছেন সুব্রত। আশির দশকে তিনি যখন ফর্মের তুঙ্গে, তখন নাইজেরিয়া থেকে এক নতুন তারকার আগমন ঘটে কলকাতার ফুটবলে, যাঁর নাম চিমা ওকোরি। চিমা তখন ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণে সেরা অস্ত্র। সেই সময়ে ডার্বি মানেই মোহনবাগানের গোল এরিয়ায় চিমা ও সুব্রতর ধুন্ধুমার ফুটবল-ডুয়াল। যা নিয়ে তখন ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা উঠত তুঙ্গে।
কৃশানু দে (মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ১৯৮২-১৯৯৪)
‘ভারতীয় মারাদোনা’ বলে ডাকা হত এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে। টানা সাত বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলেছিলেন তিনি। তখনই এই আখ্যা পান তিনি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত মোহনবাগানে খেলার পরে ইস্টবেঙ্গল কর্তারা অনেক চেষ্টার পরে ১৯৮৫-তে কৃশানুকে সই করাতে সফল হন। তার পরে ১৯৯১ পর্যন্ত লাল-হলুদ জার্সি গায়ে ভারতীয় ফুটবল মাতান তিনি। ওই সাত বছরে প্রায় একশো ম্যাচ তিনি খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে। পরে ১৯৯৪-এ ফের যোগ দিয়ে খেলেছিলেন প্রায় ৫০টি ম্যাচ। ১৯৯২-এ তিনি ফের মোহনবাগানে যোগ দেন। এই দুই দফায় মোহনবাগানের হয়ে খেলেছিলেন প্রায় ৭৫টি ম্যাচ। ওই সময়ে দলবদলে কৃশানু দে-ই ছিলেন মধ্যমণি। এক সময়ে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলারও ছিলেন তিনি। তখন ডার্বি মানেই কৃশানু ও বিকাশ জুটির তোলা ঝড়। ১৯৮৭-তে যখন চিমা ওকোরি ইস্টবেঙ্গলের ‘গোলমেশিন’ হয়ে ওঠেন, প্রথম বছরেই তিনি কলকাতা লিগে যে ২৬টি গোল করেন, তার বেশিরভাগই আসে কৃশানুর পাস থেকে। তখন চিমাকে গোলের পাস দেওয়ার প্রধান দায়িত্ব ছিল কৃশানুর ওপরই।
শিশির ঘোষ (মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ১৯৮৫-১৯৯৭)
১৯৮৯-এ ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে তাঁর তৃতীয় গোল রেফারি মিলন দত্ত বাতিল করে দেওয়ায় আর সেই ডার্বিতে হ্যাটট্রিক পাওয়া হয়নি শিশির ঘোষের। সেই সময় ইস্টবেঙ্গলে চিমা-যুগ শুরু হয়ে গেলেও বিদেশি ফুটবলার সই না করানোর প্রথা ভাঙতে চাইতেন না মোহনবাগানের কর্তারা। তাই সবুজ-মেরুন শিবিরের গোল করার দায়িত্ব ছিল শিশিরের ওপরেই। সেই ম্যাচে শিশিরের দু-গোলেই জেতে মোহনবাগান। পাঁচ বছর পর সে দিন কলকাতা লিগের ডার্বিতে সবুজ-মেরুন শিবির জিতেছিল দাপটের সঙ্গে। এখনও তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, শিশির ঘোষই শেষ দাপুটে বাঙালি ফরোয়ার্ড। তাঁর পরে ভারতীয় ফুটবলে বহু বাঙালি স্ট্রাইকার উঠে এসেছেন ঠিকই। কিন্তু শিশির ঘোষের মতো দাপট কেউ দেখাতে পারেননি। এরিয়াল বলে ও হেডে গোল দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। প্রশান্ত ব্যানার্জি ও শিশিরের জুটি সেই সময়ে ছিল মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে সুপারহিট জুটি। ১৯৮৭-৮৮ মরশুমের ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের স্মরণীয় ৩-০ গোলে জয়ে শিশিরের অবদান ছিল যথেষ্ট।
প্রসূন ব্যানার্জি (মোহনবাগান, মহমেডান স্পোর্টিং ১৯৭৪-১৯৮৫)
বড় ক্লাবে খেলার আগেই এশীয় যুব ফুটবলে ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ পান এবং ভারতীয় দলকে যুগ্মবিজয়ী হতে সাহায্যও করেন কিংবদন্তি মিডফিল্ডার প্রসূন ব্যানার্জি। পরের বছরও একই টুর্নামেন্টে তাঁর উপস্থিতিতে ভারত রানার্স আপ হয়। ১৯৭৩-এ খিদিরপুর ক্লাবের হয়ে খেলতেন প্রসূন। সে বছর লিগে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করেন তিনি। সেই গোলের পরেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭৪-এ মোহনবাগানে যোগ দেন ভারতীয় ফুটবল কিংবদন্তি পি কে ব্যানার্জির ভাই প্রসুন। তবে এই পরিচয়ের চেয়েও নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠা করাই বরাবর লক্ষ্য ছিল তাঁর। শুরুর দিকে তেমন ভাল পারফরম্যান্স দেখাতে না পারলেও ক্রমশ দলের মাঝমাঠের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭৬-এ পিকে মোহনবাগানের কোচ হয়ে আসেন ও তার পর থেকেই টানা সাফল্যে পেতে শুরু করে মোহনবাগান। লিগ, শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স একের পর এক ট্রফি আসতে থাকে ক্লাব তাঁবুতে। ১৯৭৭-এ সেই বিখ্যাত ত্রিমুকুটও। ১৯৭৮-এ অধিনায়ক করা হয় তাঁকে। সে বছর ৭৯ গোল করে কলকাতা লিগ জেতে তাঁর দল। প্রথমবারের জন্য ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়নও হয় তারা। শিল্ডেও যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। ১৯৭৯-৮০-তে প্রসুন ও গৌতম সরকারের জুটিকে ভারতসেরা মিডফিল্ডার জুটি আখ্যা দেয় ফুটবল মহল।
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ( ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ১৯৭৭-১৯৯৩)
বছর দেড়েকের জন্য মোহনবাগানের হয়ে খেললেও ফুটবল জীবনের বাকি ১৪ বছর লাল-হলুদ তাঁবুই ছিল ফুটবলার মনোরঞ্জনের ঠিকানা। মোহনবাগান সমর্থকেরা যদি তখন সুব্রত ভট্টাচার্যকে নিয়ে গর্ব করতেন, তা হলে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের গর্ব ছিলেন এই দুর্দান্ত স্টপার। দু’জনকেই বাংলার সর্বকালের সেরা স্টপারদের তালিকায় ওপর দিকেই রাখা যাবে অনায়াসে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১—টানা ১৪ বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় ৩০টি প্রথম শ্রেণির ট্রফি (ফেডারেশন কাপ, শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স, ডিসিএম, বরদলুই, এয়ারলাইন্স, কলকাতা লিগ) এনে দিয়েছিলেন ক্লাবকে। সেই সময়ে লাল-হলুদ শিবিরে ছিল তারকাদের মেলা। ভারতীয় ফুটবলের সব বড় বড় নাম তখন একই তাঁবুতে। ভাস্কর গাঙ্গুলি, চিন্ময় চ্যাটার্জি, শ্যামল ঘোষ, প্রশান্ত ব্যানার্জি, সাব্বির আলি, মিহির বোস। সুরজিৎ সেনগুপ্ত তাঁদের অধিনায়ক।