ক্রীড়া

কেরালাকে হারিয়ে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হায়দ্রাবাদ

অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ

আইএসএল ২০২১-২২ মরশুমের চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতে নিল হায়দ্রাবাদ এফসি। রবিবার গোয়ার ফতোরদায় পন্ডিত জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে নির্ধারিত সময়ে ১-১ হওয়ার পরে দু’বারের রানার্স আপ কেরালা ব্লাস্টার্কে টাই ব্রেকারে ৩-১-এ হারাল নিজামের শহরের দল। এ বারেই প্রথম নক আউটে উঠেছিল তারা এবং এ বারেই সেরার শিরোপা অর্জন করল তারা। চার বছর পরে নক-আউটে ওঠা কেরালা ব্লাস্টার্সকে তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়নশিপের দোরগোড়া থেকে ফিরে আসতে হল। ফলে গ্যালারির প্রায় ৭০ শতাংশ ভরানো কেরালার ফুটবলপ্রেমীদের বিফল মনোরথেই স্টেডিয়াম ছাড়তে হয় রবিবার রাতে।

এ দিন প্রথমার্ধে দাপুটে ফুটবল খেলার পরে ৭৬ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যায় কেরালা ব্লাস্টার্স। দুর্দান্ত গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ফরোয়ার্ড রাহুল কেপি। তবে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে বিশ্বমানের ভলিতে গোল শোধ করেন মিডফিল্ডার সাহিল তভোরা। অতিরিক্ত সময়ে কোনও গোল না হওয়ায় ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়। এই পর্বে তিন-তিনটি শট আটকে দিয়ে হায়দ্রাবাদের জয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন হায়দ্রাবাদের গোলকিপার লক্ষ্মীকান্ত কাট্টিমণি।

এ দিন শুরু থেকেই যে বিপক্ষকে চাপে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল কেরালা ব্লাস্টার্স, তা তাদের পারফরম্যান্স দেখেই বোঝা যায়। আক্রমণের দিক থেকে তারাই এগিয়ে ছিল প্রথমার্ধে। একাধিকবার গোলের সুযোগ তৈরি করেন আলভারো ভাস্কেজরা। ফলে হায়দ্রাবাদের রক্ষণকে এ দিন শুরু থেকেই পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। তবে চোটের জন্য সহাল আব্দুল সামাদের অনুপস্থিতি দলকে কিছুটা হলেও সমস্যায় ফেলে।

প্রথম ৪৫ মিনিটে ৬০ শতাংশের ওপর বল পজিশন ছিল কেরালার দলের। হায়দ্রাবাদের চেয়ে প্রায় তিন গুণ পাস খেলেন কেরালার দলের ফুটবলাররা। মাঝে মাঝে প্রতি আক্রমণে ওঠেন হায়দ্রাবাদের অ্যাটাকররা। তবে রক্ষণের দিকেই বেশি জোর দেন মানুয়েল মার্কেজের দলের ছেলেরা। তাদের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, নিজেদের ঘর পুরোপুরি গুছিয়ে না নিয়ে আক্রমণে যেতে রাজি নন।

যাঁর খেলা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল, সেই আদ্রিয়ান লুনাকে এ দিন দলে পাওয়ায় কেরালা ব্লাস্টার্স কিছুটা উজ্জীবিত পারফরম্যান্স দেখায়। শুরুতেই গোল তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে। কিন্তু হায়দ্রাবাদের দুর্ভেদ্য রক্ষণ, যারা এটিকে মোহনবাগানকে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে একটির বেশি গোল করতে দেয়নি, তারা এ দিনও ছিল একই রকম অপরাজেয় মেজাজে।

তবে প্রথমার্ধে গোলশূন্য রাখতে পারাটা হায়দ্রাবাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে। লুনা, ভাস্কেজ ও জর্জ দিয়াজরা একসঙ্গে বিপক্ষের ওপর বারবার আক্রমণে উঠলেও হায়দ্রাবাদের রক্ষণের জালে আটকে যান তাঁরা। ৩৯ মিনিটের মাথায় বক্সের মধ্যে থেকে হরমনজ্যোৎ খাবরার ছোট পাস পেয়ে বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন ভাস্কেজ, যা বারে লেগে ফিরে আসে।

অন্য দিকে, হায়দ্রাবাদ মূলত রক্ষণ-নির্ভর ফুটবলই খেলে। তবে আক্রমণে ওঠে মাঝে মাঝে। কিন্তু জোয়েল চিয়ানিজ এ দিন পুরোপুরি ফিট ছিলেন না বলে ৩৯ মিনিটের মাথায় তাঁকে তুলে হাভিয়ে সিভেরিওকে নামান কোচ মার্কেজ। সিভেরিও নামার পরে হায়দ্রাবাদের আক্রমণ-প্রবণতা কিছুটা বাড়তে দেখা যায়। প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে গোলের সামনে থেকে নেওয়া সিভেরিওর হেড প্রভসুখন গিল শরীর দিয়ে আটকে না দিলে হায়দ্রাবাদ তখনই এগিয়ে যেত।

দ্বিতীয়ার্ধে হায়দ্রাবাদ আক্রমণে ধার বাড়াতে শুরু করে। যার জেরে বিপক্ষের রক্ষণ আগের চেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৫৫ মিনিটের মাথায় হরমিপম ও লেসকোভিচের মাঝখান দিয়ে ওগবেচেকে গোলের পাস দেন আশিস রাই। কিন্তু ওগবেচে বল বারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেন। ৬৫ মিনিটের মাথায় সিভেরিও গোলমুখী শট খাবরার পায়ে লেগে গোলের বাইরে চলে যায়।

এই চাপ সামলে আক্রমণে ফিরে আসে কেরালা ব্লাস্টার্স এবং ৬৮ মিনিটের মাথায় রাহুল কেপি-র অনবদ্য গোলে এগিয়েও যায় তারা। মাঝমাঠে আকাশ মিশ্রর পা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া বল পেয়ে ডানদিক দিয়ে বক্সের দিকে এগিয়ে যান অরক্ষিত রাহুল। বক্সে ঢোকার আগেই যে তিনি গোলে শট নেবেন, তা বোধহয় বিপক্ষের কেউই ভাবতে পারেননি। এমনকী গোলকিপারও নন। তাই বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া রাহুলের জোরালো ও মাপা গোলমুখী শট বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে ধরতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরী করে ফেলেন গোলকিপার কাট্টিমণি এবং বল তাঁর আঙুলে ও পোস্টের ভিতরের অংশে লেগে গোলে ঢুকে যায় (১-০)।

এই গোল খাওয়ার পরেই মরিয়া হয়ে ওঠে হায়দরাবাদ এফসি এবং ৭৪ মিনিটের মাথায় ব্লাস্টার্সের বক্সের ডি-এর মধ্যে গোলে শট নিতে যাওয়ার আগেই ওগবেচেকে বাধা দিয়ে তাদের ফ্রি কিক উপহার দেন গোলদাতা রাহুল। ফ্রি কিক থেকে ওগবেচে সোজা গোলে শট নেন, যা ডানদিকে ডাইভ দিয়ে দুর্দান্ত ভাবে বাঁচান গিল। তিনি এক্ষেত্রে সেভ না করলে সমতা এনে ফেলত হায়দরাবাদ। ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগও ব্লাস্টার্সের কাছে চলে আসে ৮৫ মিনিটের মাথায়, যখন তারা বিপক্ষের বক্সের ডি-এর মধ্যে ফ্রি কিক পায়। তবে লুনার গোলমুখী ফ্রি কিক ডানদিকে ডাইভ দিয়ে বাঁচিয়ে নেন কাট্টিমণি।

হায়দ্রাবাদ অবশ্য সমতা এনে ফেলে ৮৮ মিনিটের মাথায়। বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া সাহিল তাভোরার বিশ্বমানের ভলি আটকাতে পারেননি গোলকিপার গিল (১-১)। মার্কো লেসকোভিচ হেড করে বল ক্লিয়ার করার পরে ফিরতি বলে এই ভলি মারেন তাভোরা। এ বারের লিগের অন্যতম সেরা গোল এটি। কোনও ফাইনালের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে যদি সমতা চলে আসে, তা হলে সেই ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আর সেটাই হয়।

অতিরিক্ত সময়ে দুই দলই ব্যবধান বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে কেরালার দাপটই ছিল বেশি। সাত মিনিটের মাথায় বক্সের ভেতরে ওগবেচের ব্যাক ভলি গোলের বাইরে চলে যায়। ১১ মিনিটের মাথায় লুনার ভাসনো বলে জিকসন সিংয়ের হেড বারে লেগে ফিরে আসে। দ্বিতীয়ার্ধেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় দুই পক্ষের। ১৯ মিনিটের মাথায় কেরালার বক্সের মধ্যে লেস্কোভিচের ক্রস থেকে গোলে শট নেন ওগবেচে, যা ফের ডানদিকে ঝাঁপিয়ে সেভ করেন গিল।

টাই ব্রেকারে কেরালা ব্লাস্টার্সের আয়ূষ অধিকারী ছাড়া কেউ গোল করতে পারেননি। মার্কো লেস্কোভিচ ও জিকসন সিংয়ের শট আটকে দেন কাট্টিমণি। নিশু কুমার দ্বিতীয় শট নেওয়ার সুযোগ পেয়েও গোল করতে পারেননি। হায়দ্রাবাদ এফসি-র জোয়াও ভিক্টর ও খাসা কামারা গোল পেলেও হাভিয়ে সিভেরিওর শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। অবশেষে হালিচরণ নারজারি জয়সূচক গোলটি করে দলকে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি এনে দেন।