এনএফবি, বহরমপুরঃ
বহরমপুর গার্লস কলেজে ‘সেন্টার ফর মুর্শিদাবাদ স্টাডিজ’ এর উদ্যোগে একদিনের রাজ্যস্তরের আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকার প্রাচীন ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা। এই আলোচনা চক্রটি মুর্শিদাবাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলনকে উদঘাটন করার অভিপ্রায়ে অগ্রসর হয়। বিশেষত, এই অঞ্চলের পত্রপত্রিকা কিভাবে সমাজে ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে তার গভীরতর বিশ্লেষণ মূল লক্ষ্য ছিল।
প্রাচীন ও সমকালীন মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকা ও তাদের সার্থকতা, ইতিহাস এবং গুরুত্ব পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি উর্বর জ্ঞান বিনিময়ের পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য ছিল এই সেমিনারের প্রধান দিক। প্রাচীনকাল থেকে মুদ্রণ মাধ্যমের বিবর্তন ও সমকালীন সাংবাদিকতার পরিবর্তন নিয়ে যেমন বিশদ আলোচনায় স্থান পায়, তেমনি এই পরিবর্তনশীল ধারার প্রভাব, সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা করা হয়।
আলোচনা চক্রে দেড় শতাধিক শিক্ষক ও ছাত্রীরা বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করেন, যা এই চক্রের আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর মাত্রা প্রদান করে। এতে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক পত্রপত্রিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে সমর্থ হন। বহুমুখী আলোচনার মাধ্যমে, শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণার খোরাক পায়, সেমিনারটি বাস্তবায়িত হয় একই প্ল্যাটফর্মে ক্যাম্পাস জগৎ ও প্রফেশনাল দক্ষতা উন্মোচনের মাধ্যমে।
তথ্য ও জ্ঞান বিনিময়ের পথিকৃত হিসেবে, সেমিনারটি মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকা সম্বন্ধে এক সুসংবদ্ধ ও বিস্তৃত ধারণা প্রদানে প্রতিজ্ঞ ছিল এবং সেই লক্ষ্য পূরণে শৈক্ষিক ও প্রফেশনাল স্তরে সক্ষম হয়েছে বলে অংশগ্রহণকারী সকলে অভিমত প্রদান করেন।
বিশেষ অতিথিরা এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রতিক্রিয়া
এই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ ড. শক্তিনাথ ঝা এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ডক্টর দেবাশীষ ভট্টাচার্য। তাঁদের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে তাঁরা আলোচনা চক্রকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। বাঙলা সাহিত্যের উন্নয়নে মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকার ভূমিকা নিয়ে তাঁদের বক্তব্য ছিল অনুপ্রেরণামূলক। বিশেষভাবে ড. ঝা লোকসংস্কৃতির তাৎপর্য ও ইতিহাসের উপর আলোকপাত করেন, যা উপস্থিত সকলকে নতুন দৃষ্টিতে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
সেমিনারে অন্যতম মুখ্য আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও লেখকদের উপস্থিতি। তাঁরা তাঁদের নিজেদের পত্রিকার ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলি তুলে ধরার পাশাপাশি, বর্তমান পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও আলোকপাত করেন। এতে মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকার অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এক সেতুবন্ধনের সূচনা হয়।
বহরমপুর গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর হেনা সিনহা সেমিনারের উদ্বোধন করেন। তাঁর অভিভাষণে, ডক্টর সিনহা শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস ও গবেষণার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন। সেটি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নতুন উদ্যম বর্ষণ করে।
এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সেমিনারের প্রতি উদ্দীপনা ছিল অত্যন্ত চোখে পড়ার মত। তাঁরা বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে আলোচনাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন। শিক্ষার্থীদের এই অদম্য উৎসাহ শ্রদ্ধেয় অতিথিদেরকেও আশাবাদী করে তোলেন যে আগামী দিনে মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকা গবেষণায় তাঁরা সাফল্য অর্জন করবে।
এই সেমিনারের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদের পত্রপত্রিকা, তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আধুনিক প্রেক্ষাপটে তাদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যা সকল অংশগ্রহণকারীর মনকে বিমুগ্ধ করে তুলেছিল।
মুর্শিদাবাদের লিটিল ম্যাগাজিন বিষয়ে আলোচনা
মুর্শিদাবাদের লিটিল ম্যাগাজিন বিষয়ে আলোচনাচক্রে বিশিষ্টজনেরা তাদের মূল্যবান মতামত ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। লিটিল ম্যাগাজিনের ইতিহাস বিস্তর। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন সাধারণ মানুষের হাতে মূলধারার পত্রপত্রিকা পৌঁছানো কঠিন ছিল, তখন ছোট ছোট লিটিল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে লেখক, কবি ও সাহিত্যিকেরা তাদের কৃতিত্ব প্রকাশ করতেন। মুর্শিদাবাদ এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই; এখানকার কথাসাহিত্যিক ও কবিরা উৎসারিত চিরস্থায়ী শৈল্পিক প্রভাব লিটিল ম্যাগাজিনের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে লিটিল ম্যাগাজিনের ভূমিকা এবং লক্ষণীয় অবদান প্রশংসনীয়। কাজের ব্যস্ততার ফাঁকেও সাহিত্যপ্রেমীরা লিটিল ম্যাগাজিনে তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছেন। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে, লিটিল ম্যাগাজিনের প্রভাব ও পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। অনলাইন প্রকাশনা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ই-সংস্করণের মাধ্যমে লিটিল ম্যাগাজিন আজ যেখানে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের কারণে মুর্শিদাবাদের লিটিল ম্যাগাজিন আন্তর্জাতিক পরিসরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং তার পরিসরের গণ্ডি ক্রমাগত বাড়ছে।
লিটিল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। বর্তমান প্রজন্মের পড়ুয়া ও পাঠকেরাও এই মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। মুর্শিদাবাদে সাহিত্যিক চর্চার পরিধি বাড়ছে এবং নতুন নতুন মুখও উঠে আসছে। লেখালেখির মাধ্যমে সামাজিক বিষয়াবলি ও ব্যক্তিগত চিন্তাধারা করতালিকাভুক্ত করতে লিটিল ম্যাগাজিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সর্বোপরি, আলোচনাচক্রে উপস্থিত সবাই আশাবাদী যে, মুর্শিদাবাদের লিটিল ম্যাগাজিন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক মূল্যবোধে অটুট থাকবে। সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই মাধ্যমেরও উন্নতি ও প্রসারণ ঘটবে এবং তা একদিন সর্বজনপরিচিত হবে।
সেন্টার ফর মুর্শিদাবাদ স্টাডিজ এর ভূমিকা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
সেন্টার ফর মুর্শিদাবাদ স্টাডিজ (সিএমএস) তার অধিকর্তা ড. মধু মিত্রের নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদ চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ড. মিত্র জানালেন, এই গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান উদ্দেশ্য হল মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ধারা নিয়ে গভীর গবেষণা করা, এবং সেই গবেষণার ফলাফলগুলি দেশের এবং বিদেশের পরিসরে পৌঁছে দেওয়া।
সিএমএস নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চক্র ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। এই আলোচনা চক্রগুলিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, যাদের নির্দিষ্ট বিষয়গুলিতে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই ধরনের উপস্থাপনা ও আলোচনা শুধুমাত্র গবেষণাবিদদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগও দেয়। এভাবে কেন্দ্রটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে থাকে।
ভবিষ্যতে, সিএমএস-এর অন্যতম প্রধান পরিকল্পনা হল একটি অনলাইন ডাটাবেস তৈরি করা যেখানে মুর্শিদাবাদ সম্পর্কিত সবধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। এই ডাটাবেসটি গবেষকদের এবং আগ্রহীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হবে। এছাড়া, সিএমএস একটি বার্ষিক জার্নাল প্রকাশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেখানে মুর্শিদাবাদ সম্পর্কিত নতুন নতুন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হবে।
মুর্শিদাবাদের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সহযোগিতা করাও সিএমএস-এর অন্যতম লক্ষ্য। এভাবে তারা একটি বিস্তৃত গবেষণা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট আছে যা মুর্শিদাবাদ চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। ড. মিত্র মনে করেন, এই কেন্দ্রে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে রয়েছে যা মুর্শিদাবাদকে একটি গবেষণা উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
আরও পড়ুনঃ “সমকালীন প্রেক্ষিতে মুর্শিদাবাদের কবি ও কবিতা” নিয়ে বহরমপুর গার্লস’ কলেজে রাজ্যস্তরীয় আলোচনাচক্র