অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ
মেয়েদের এএফসি এশিয়ান কাপে সাফল্য পেয়ে কি আগামী বছর বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে পারবে ভারত? গত পাঁচ মাস ধরে যে ভাবে ভারতের মহিলা দলের প্রস্তুতি হয়েছে, যে ভাবে তাঁরা বিদেশে প্রস্তুতি সফর করেছেন, তার পরে এই ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী ভারতীয় মহিলা দলের হেড কোচ থমাস ডেনারবি। তাঁর বক্তব্য, দল এখন এশিয়া কাপে খেলার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পরীক্ষাটা বেশ কঠিন। কারণ, গ্রুপ পর্বেই তাদের মুখোমুখি হতে হবে ইরান, চিন ও চিনা তাইপের। তার পরে নক আউট পর্বে খেলার সুযোগ পাবে।
নাইজেরিয়ার মহিলা দলের সঙ্গে কাজ করে আসা সুইডিশ কোচ থমাস ডেনারবির বক্তব্য, “দীর্ঘ সময় প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা। পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে একসঙ্গে কাজ করছি। অনুশীলন, ট্রেনিং, প্র্যাকটিস ম্যাচ মিলিয়ে ২০০-রও বেশি সেশন করেছি আমরা। আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে মেয়েরা। এখন আমাদের মনে হচ্ছে আমরা প্রস্তুত। আসন্ন ম্যাচগুলিতেও তার প্রতিফলন দেখা যাবে, আশা করি।” নভি মুম্বইয়ে বৃহস্পতিবার ইরানের বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে মহাদেশীয় অভিযান শুরু করছে ভারত।
লক্ষ্য শেষ আট
তাদের প্রথম লক্ষ্য যে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা, তা জানিয়ে কোচ বলে দিয়েছেন, “কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারলে যে কোনও ঘটনা ঘটতে পারে। নক আউট পর্বে কে কেমন খেলবে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা বেশ কঠিন। প্রত্যেক দলই চাপে থাকবে। তাই কোয়ার্টার ফাইনালই আপাতত আমাদের বাস্তবসম্মত লক্ষ্য।” ইএসপিএন ডট কমে কথাগুলি বলেন ডেনারবি।
আরও পড়ুনঃস্থগিত মোহনবাগান-কেরালা ম্যাচ
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারলেও কিন্তু ভারতের বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করার একটা সম্ভাবনা থেকে যাবে। মোট ১২টি দলকে নিয়ে দেশের তিনটি ভেনুতে হচ্ছে মহিলাদের এশিয়া কাপ। এই ১২টি দলকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। আয়োজক দেশ ভারত রয়েছে ‘এ’ গ্রুপে। তাদের সঙ্গে এই গ্রুপে রয়েছে চিন, চিনা তাইপে এবং ইরান।
রাউন্ড রবিন ফরম্যাটে টুর্নামেন্ট শুরু হবে। প্রতি দলকে গ্রুপের বাকি তিন দলের মুখোমুখি হতে হবে। তার পরে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচগুলি হবে ৩০ জানুয়ারি। সেমিফাইনাল ৩ ফেব্রুয়ারি ও ফাইনাল ৬ ফেব্রুয়ারি।
আরও পড়ুনঃসুব্রতর চেয়ারে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই –
প্রতি গ্রুপ থেকে প্রথম দুই দল সরাসরি চলে যাবে কোয়ার্টার ফাইনালে। বাকি দু’টি জায়গা পূরণ করবে তিন গ্রুপের তৃতীয় স্থানাধিকারী দলগুলির মধ্যে সেরা দু’টি দল। চার সেমিফাইনালিস্টের আগামী বছর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে মহিলাদের ফিফা বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা পাকা হয়ে যাবে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে হারলেও সেই সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যাবে না। আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফে জিতে সেই স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।
ভারতের প্রতিপক্ষ কেমন?
ভারতের মেয়েদের সামনে একটা বড়সড় ইতিহাস গড়ার সুযোগ একেবারে স্পষ্ট। যে সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য এ বার যথেষ্ট ভাল প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। এই প্রস্তুতির মূল পর্ব ছিল ছ’টি দেশে গিয়ে তাদের জাতীয় দলের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা। ব্রাজিল, সুইডেন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, বাহরিন এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী সফরে গিয়ে ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলার মতো দলের বিরুদ্ধে এই ম্যাচগুলি খেলেছিলেন ভারতের মহিলা ফুটবলাররা। ভেনেজুয়েলা, চিলি ও ব্রাজিলের বিরুদ্ধে তাদের পারফরম্যান্স খারাপ হয়নি ঠিকই। কিন্তু দেশের মাঠে ক্লাব ফুটবলে বেশি ম্যাচ না খেলাটা এই দলের ফুটবলারদের বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
“আমরা বিভিন্ন স্তরের ফুটবল খেলেছি এই সফরগুলিতে। বিভিন্ন স্টাইলের ফুটবল খেলেছি। ব্রাজিলে গিয়ে চার দিনে দু’টি ম্যাচ খেলেছি। এশিয়ান কাপেও তা-ই খেলতে হবে। ওখানে গিয়ে আমরা শিখেছি প্রতি ম্যাচেই আমাদের একশো শতাংশ ফিটনেস বজায় রাখতে হবে”, বলেন ভারতীয় দলের হেড কোচ। তাঁর মতে, “ইরানের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রথম ম্যাচটা বেশ কঠিন। কারণ, ইরানের রক্ষণ বেশ শক্তিশালী এবং সঙ্ঘবদ্ধ। এই দলের একজন ক্ষিপ্র স্ট্রাইকার আছে, যাকে কেন্দ্র করে কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠে ইরান। ফলে আমরা আধিপত্য বিস্তার করলেও এমন ক্ষিপ্র প্রতি আক্রমণ সামলানোর জন্য আমাদের রক্ষণকে সব সময় তৈরি থাকতে হবে। সেট পিসেও ওরা যথেষ্ট ভাল। কর্ণার ও ফ্রি কিক থেকে প্রচুর গোল করেছে ওরা। তাই এই দিকেও তৎপর ও সজাগ থাকতে হবে।” প্রসঙ্গত, এই বছরেই প্রথম এশিয়ান কাপে অংশ নিচ্ছে ইরান।
আরও পড়ুনঃমরশুমের প্রথম জয় পেলো এসসি ইস্টবেঙ্গল
চিনা চাইপের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচটি সমানে সমানে হতে পারে বলে ডেনারবির ধারণা। কিন্তু চিনের বিরুদ্ধে নয়। “ওরা ক্লাসিকাল এশিয়ান স্টাইলে খেলে”, বক্তব্য ভারতীয় কোচের, “ছোট ছোট পাসে ভাল কম্বিনেশনে খেলে ওরা। চিনের বিরুদ্ধে ম্যাচটাও কঠিন। কিন্তু দু’বছর আগে যখন ওরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তখনকার মতো আর নেই এখন। তা সত্ত্বেও এই ম্যাচটাই আমাদের কঠিনতম ম্যাচ হতে চলেছে।” গত বছর চিনা তাইপেকে হারায় ভারত।
দেশের মাঠে খেলা। ভারত সেই সুবিধা তো পাবেই। তবে সমর্থকহীন স্টেডিয়ামেই খেলতে হবে তাদের। তাই সেই সুবিধা পুরোপুরি ভাবে পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু চেনা মাঠ, চেনা পরিবেশের সুবিধা তো পাওয়া যায়ই। তা ছাড়া আরও একটা সুবিধা হল দলের সদস্যারা সমবয়সি। ২৩ সদস্যার যে দল ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে ১৫ জনেরই বয়স ২৫ বছর বা তার কম। যদিও নির্ভরযোগ্য সদস্যা বালা দেবীকে পাওয়া যাবে না এই অভিযানে, তবু কোচ বলছেন, সেরা দলই নামাবেন তিনি। গতবার যখন এই টুর্নামেন্ট ভারতে হয়েছিল, তখন ভারতের মেয়েরা ফাইনালে ওঠে। তবে সে ৪২ বছর আগের ঘটনা।
কেমন দল ভারতের?
সম্প্রতি ২৩ জনের দল ঘোষণা করেছে ভারত। এই দলে গত মাসে ঢাকায় অনূর্ধ্ব ১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স আপ ভারতীয় দলের চার সদস্যাও জায়গা পেয়েছেন। এঁরা হলেন ডিফেন্ডার হেমাম সিল্কি দেবী, ফরোয়ার্ড মারিয়াম্মল বালামুরুগন ও সুমতি কুমারী এবং ডিফেন্ডার নাওরেম প্রিয়াঙ্কা দেবী। ভারতীয় মহিলা ফুটবলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য তারকা বালা দেবী, সেপ্টেম্বরে যাঁর হাঁটুতে অস্ত্রোপচার (এসিএল) হয়েছিল, তিনি এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি বলে এই দলে নেই।
ভারতের দল এ রকম (জার্সি নম্বর-সহ):
গোলকিপার – অদিতি চৌহান (১), মাইবাম দেবী (২৩), সৌম্যা নারায়ণস্বামী (১৯); ডিফেন্ডার – ডালিমা ছিবার (১৭), সুইটি দেবী (২), ঋতু রানী (২১), আশালতা দেবী (৪), মণীশা পান্না (৩), হেমাম সিল্কি দেবী (৫), সঞ্জু যাদব (৮); মিডফিল্ডার – কমলা দেবী (৬), অঞ্জু তামাং (৯), কার্তিকা অঙ্গমুথু (২০), রতনবালা দেবী (৭), প্রিয়াঙ্কা দেবী (১৪), ইন্দুমতি কাথিরেসন (১২); ফরোয়ার্ড – মণীশা কল্যাণ (১৬), গ্রেস দাঙ্গমি (১১), পিয়ারি জাজা (১০), রেণু (১৫), সুমতি কুমারী (২২), সন্ধ্যা রঙ্গনাথন (১৩), মারিয়াম্মল বালামুরুগন (১৮)।
যদিও ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করেনি সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন, তবে আশালতা দেবীকে হয়তো নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড দেওয়া হবে। কোচিতে যে ২৭জনকে নিয়ে প্রস্তুতি শিবির করা হয়েছিল, তার মধ্যে ২৩জনকে নিয়ে এশিয়ান কাপের দল গড়া হয়েছে।
ফেভারিট কারা?
অস্ট্রেলিয়াই এই মুহূর্তে মেয়েদের ফুটবলে এশিয়ার সবচেয়ে সফল দল। গত পাঁচবারের মধ্যে চার বারই ফাইনালে উঠেছে তারা। তবে ফাইনালে উঠলেও তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে একবারই, ২০১০-এ। সম্প্রতি প্রস্তুতি ম্যাচে তারা ব্রাজিলের মতো দলকে হারালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরেছে। গত বছর টোকিও অলিম্পিক্সে চতুর্থ স্থান অধিকার করে অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ হাতছাড়া করে তারা। এশিয়ান কাপে নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে নামবে তারা।
গতবারের চ্যাম্পিয়ন জাপানও অন্যতম ফেভারিট। কিন্তু দলটা একটা সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন দলের মাত্র ১১জন এ বারের ২৩ জনের স্কোয়াডে রয়েছে। ২০১১-য় বিশ্বকাপ জয়ী দলের দুই সদস্যা সাকাগুচি ও উতসুগিকে এ বার তারা পাচ্ছে না। গতবছর নিজেদের দেশে হওয়া অলিম্পিক্সের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়ার ঘা এখনও তাদের দগদগে হয়ে রয়েছে। সেই জ্বালা ভুলতে এ বার এশীয় খেতাব জিততে মরিয়া হয়ে উঠবে জাপান।
তবে চিন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো কালো ঘোড়াদের একেবারে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ১৯ বারের মধ্যে আটবার এশীয় খেতাব চ্যাম্পিয়ন চিন টানা সাতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৯-এর মধ্যে। তবে গত ২২ বছরে মহিলাদের ফুটবলে চিনের গর্ব খর্ব হয়েছে বহুবার। এই কয়েক বছরে মাত্র একবার, ২০০৬-এ এশীয় সেরার মুকুট জেতে তারা। কিন্তু অন্যান্যবারে আর সাফল্য অর্জন করতে পারেনি তারা। গত অলিম্পিক্সে খুবই খারাপ ফল করে চিনা মেয়েরা। গ্রুপে একেবারে নীচে ছিল তারা। ব্রাজিলের কাছে ০-৫, নেদারল্যান্ডসের কাছে ২-৮-এ হারে তারা। সেক্ষেত্রে বলা যায়, ভারতের কাছে এটা একটা ভাল সুযোগ।
কোভিড সমস্যা হলে?
মুম্বই, নভি মুম্বই ও পুনে—এই তিন ভেনুতে কঠোর জৈব সুরক্ষা বলয় থাকলেও তা ভেদ করে যদি কোভিড-১৯ ভাইরাস হানা দেয়, তখন কী হবে? হিরো আইএসএলের অভিজ্ঞতা হওয়ার পরে ঠিক হয়েছে যে, টুর্নামেন্ট বন্ধ করা যাবে না। যে খেলোয়াড়রা আক্রান্ত হবেন, তাঁদের আইসোলেশনে রাখা হবে। কিন্তু তাদের দল মাঠে নামবে। যতক্ষণ দলগুলি অন্তত ১৩জন মাঠে নামানোর অবস্থায় থাকবে, ততক্ষণ তাদের ম্যাচ খেলতে হবে।