এনএফবি, পূর্ব মেদিনীপুরঃ
সেঞ্চুরি পার করেছেন দু-বছর আগেই। কিন্তু সারাদিনের কাজের বহর দেখলে মনে হবে প্রাণবন্ত যুবক। বয়সের কোনও ছাপ-ই পড়েনি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া শিল্পশহর লাগোয়া দেভোগ গ্ৰাম পঞ্চায়েতের কিসমত শিবরামনগর গ্ৰামের বাসিন্দা পরেশচন্দ্র বেতালের শরীরে বা কাজ কর্মে। সকাল থেকে জমিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। চারা রোপন থেকে ঘাস-আগাছা পরিষ্কার, জ্বালানি গোছানো-সব কাজই করেন সেঞ্চুরি পার হওয়া পরেশ চন্দ্র বেতাল। কাজ কর্মের পাশাপাশি নিয়মিত রেডিওতে খবরও শোনেন তিনি। ১০২ বছর বয়সে এসে পরেশবাবুর এই কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ভাবেই সকলকে হতবাক করছে।
হলদিয়া শিল্পশহর লাগোয়া কিসমত শিবরামনগর গ্ৰামের বাসিন্দা পরেশচন্দ্র বেতালের নিজের জন্মের ইংরেজি সাল, তারিখ ঠিক মনে নেই। তবে বাংলা সাল-মাস মনে রয়েছে, ১৩২৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাস। তাঁর বাবা ক্ষুদিরাম বেতাল ছিলেন পেশায় শিক্ষক। মা গিরিবালা বেতাল ছিলেন গৃহবধূ। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে পরেশবাবু ছিলেন সকলের বড়। তাই বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর তাঁকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। পড়াশোনা খুব বেশিদূর করা হয়নি। ছোট থেকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ধান, সবজি চাষ থেকে পান বরজের কাজ-সবই কম-বেশি তিনি কাজ করেছেন। এমনকি গ্রামের ঘর ছাওয়া থেকে মাটি কাটার কাজও করেছেন। চার বোনের বিয়েও দিয়েছেন। বর্তমানে অবশ্য সকলেই প্রয়াত। কিন্তু তিনি আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
পরেশ চন্দ্রবাবুর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। কয়েক বছর আগে এক ছেলে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। স্ত্রীও বছর ৪০ আগে প্রয়াত হয়েছেন। বর্তমানে এক ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি মিলিয়ে পরেশ বাবুর পরিবারে সদস্যর সংখ্যা ৮। ছেলেরা, নাতিরা সংসারের হাল ধরেছেন। তবু বসে নেই পরেশ বাবু। যদিও বয়সের ভারে এখন আর ভারী কাজ করতে পারেন না। তবে বাড়ির লোকের হাজার বাধা উপেক্ষা করেও তিনি কখনও ঘাস কাটছেন তো কখনও জ্বালানি গোছাতে ব্যস্ত। বৃদ্ধের কথায়, “কাজ না করে বসে থাকতে পারি না।” কিন্তু কোন জাদুবলে ১০২ বছর বয়সেও প্রাণবন্ত, সবল পরেশ চন্দ্র বেতাল? এর সঠিক উত্তর অবশ্য পরেশ বাবুরও জানা নেই। তবে একে বারে নিয়ম মেনে তিনি চলেন। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঠাকুর-নাম করে মুখ ধুয়ে রেডিওতে খবর শোনেন। এরপর নিজেই পান সাজিয়ে খেয়ে চিবোতে চিবোতে কাজে লেগে পড়েন। সকালের দিকে রোদের তেজ থাকায় মাঠে গিয়ে একে বারে নিজে দাঁড়িয়ে ধান চাষের কাজ করান। তারপর দুপুরে একাই পুকুরে নেমে স্নান করেন। কোমর নুইয়ে গিয়েছে। ঠিক মতো হাতে তুলে খেতে পারেন না। চামচের সাহায্যে খেতে হয়। তাই মাছ, মাংসের বদলে সবজি বেশি পছন্দ করেন। মধ্যাহ্নভোজের পর একটু জিরিয়ে ফের বিকেল হতেই নুয়ে-নুয়েই পাড়ায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা নামলে ফের ঘরে এসে রেডিওতে খবর শোনেন। রাত নটার মধ্যেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বয়স ১০০ পেরিয়ে গেলেও অসুখ তেমন নেই। মাস কয়েক আগে কেবল একবার বদহজমের জন্য হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিল। রাজনীতিও খুব পছন্দ করেন পরেশবাবু। এখনও ভোট দেন। কিন্তু কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে নেতৃত্ব দিতে চাননি। শুরুতে কংগ্রেস, এখন তৃণমূলকে সমর্থন করেন। বৃদ্ধের কথায় “আগে কংগ্রেস করলেও এখন ভোট আমি তৃণমূলকেই দিই।”যদিও পরেশবাবু বা তাঁর পরিবার সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাননি বলে অভিযোগ। এমনকি বার্ধ্যক্য ভাতাও জোটে না। এলাকার সকলে পেলেও আপনি কেন বঞ্চিত? জবাবে সরকারের কাছে করুণ আবেদন জানিয়ে ১০২ বছরের বৃদ্ধ বলেন, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছি না। হাতের আঙ্গুলের ছাপও মিলছে না। সরকার যদি আমাকে অন্য কোনও ভাবে মাসে হাজার টাকা দেন, খুব ভালো হয়।