জুলাই 5, 2024
Latest:
ক্রীড়া

দেশি ফুটবলার নিয়ে লড়াই করেও শেষ মুহূর্তে হার লাল হলুদের

অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ

সারা ম্যাচে বিপক্ষকে আটকে রেখেও শেষ মুহূর্তের গোলে হার স্বীকার করতে হল এসসি ইস্টবেঙ্গলকে। ৮৮ মিনিটে ইশান পন্ডিতার গোলে পাঁচ নম্বর জয় পেয়ে লিগ টেবলের শীর্ষে উঠে গেল জামশেদপুর এফসি। লাল হলুদ বাহিনীর দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভেদ করার চেষ্টা বারবার করেও সফল হলেন না গ্রেগ স্টিউয়ার্ট জর্ডান মারের মতো দুর্ধর্ষ অ্যাটাকাররা। এসসি ইস্টবেঙ্গলের জমাটবদ্ধ রক্ষণে আটক হয়ে যান তাঁরা। কিন্তু লাল-হলুদ রক্ষণের অন্যতম স্তম্ভ আদিল খান চোট পেয়ে বাইরে যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ইস্পাতনগরীর দলের আক্রমণকারীরা এবং ওপেন প্লে-তে ব্যর্থ হওয়ার পরে সেই সেট পিস মুভ থেকেই জয়সূচক গোলটি তুলে নেয় তারা।

এক সপ্তাহের মধ্যে লিগ টেবলের শীর্ষে দেখা গেল চার-চারটি দলকে। মুম্বই সিটি এফসি , হায়দ্রাবাদ এফসি, কেরালা ব্লাস্টার্স ও জামশেদপুর এফসি। এ বারের হিরো আইএসএলে শীর্ষস্থান দখলের লড়াই যে চরমে উঠেছে, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? এই চার দলই এখন সেরা চারে রয়েছে। এবং এই চার দলের মধ্যে মাত্র চার পয়েন্টের ফারাক। ১১ ম্যাচে জয়হীন এসসি ইস্টবেঙ্গল তাদের পাঁচ নম্বর হারের পরে লিগ টেবলের সর্বশেষ স্থানেই রয়ে গেল।

৪৫ মিনিটঃ স্টপেজ টাইমে কর্নার থেকে জামশেদপুরের বরিস সিং হেডে গোল করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু বারের ওপর দিয়ে তা উড়ে যায়।
৫৫ মিনিটঃ জর্ডান মারের গোলমুখী হেড ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে।
৬৫ মিনিটঃ বক্সের মাথা থেকে গোলে মারের মাটিঘেঁষা শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচান অরিন্দম।
৮৮ মিনিটঃ গ্রেগ স্টিউয়ার্টের মাপা কর্নারে নিখুঁত হেডে গোল করে দলকে বহু আকাঙ্খিত জয় এনে দেন ইশান পন্ডিতা। ছ’গজের বক্সের বাঁ দিকে এই হেড করেন ইশান্ত।
এ দিন এগারোজন ভারতীয় ফুটবলারকে নিয়ে দল নামান এসসি ইস্টবেঙ্গলের অন্তর্বর্তী কোচ রেনেডি সিং। এ ছাড়া অবশ্য তাঁর সামনে কোনও উপায় ছিল না। কারণ, দলের বিদেশিরা সবাই আনফিট। অর্ধেক ফিট ড্যারেন সিডোলকে রাখা হয় ডাগ আউটে। তাঁকে দ্বিতীয়ার্ধে নামানো হয় আদিল খানের চোট লাগার পরে। আগের দুই ম্যাচের মতোই ৪-১-৪-১-এ দল সাজান রেনেডি। সেম্বয় হাওকিপকে সামনে রেখে তাঁর পিছনে মহেশ, রফিক, লুয়াং ও হামতেকে রাখেন তিনি। হীরা, আদিল, অঙ্কিত, অমরজিৎ রক্ষণে বিপক্ষের দুর্ধর্ষ ফরোয়ার্ড গ্রেগ স্টিউয়ার্ট, জর্ডান মারেদের সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন।

অন্যদিকে, জামশেদপুরের স্কটিশ কোচ আওয়েন কোইল তাঁর দল সাজান মারেকে একেবারে সামনে রেখে, ৪-২-৩-১-এ। স্টিউয়ার্ট ছিলেন তাঁর পিছনে। টিপি রেহনেশের জায়গায় এ দিন পবন কুমারকে জামশেদপুরের গোলে দেখা যায়। এই নিয়ে লিগে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলেন তিনি। তবে সারা ম্যাচে তাঁকে সে রকম পরীক্ষার সামনে পড়তে হয়নি। কারণ, ৯০ মিনিটের খেলায় এসসি ইস্টবেঙ্গল মাত্র একটি শট গোলে রাখতে পারে। সারা ম্যাচে একটিও কর্নার আদায় করতে পারেনি তারা। সেখানে ১১টি কর্নার পায় জামশেদপুর (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন)। তার মধ্যে কাজে লাগে মাত্র একটি, একেবারে শেষেরটি।

প্রত্যাশিত ভাবেই এ দিন শুরু থেকেই বিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করে জামশেদপুর এফসি। এসসি ইস্টবেঙ্গল পুরোপুরি রক্ষণাত্মক না খেলে মাঝে মাঝে প্রতি আক্রমণে ওঠে। তবে প্রথমার্ধে কোনও পক্ষই বিপক্ষের গোলে কোনও শট রাখতে পারেনি। দুই গোলকিপারকে এই সময়ে সে ভাবে পরীক্ষাই দিতে হয়নি। বরং অরিন্দমের দলের রক্ষণকে অনেক বেশি পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সারা অর্ধে জামশেদপুর সাত-সাতটি কর্নার আদায় করে নিলেও কোনওবারেই তাদের গোল-মুখ খোলার চেষ্টায় সফল হতে দেননি লাল-হলুদ ডিফেন্ডাররা।

জামশেদপুর বিপক্ষের চেয়ে বেশি সংখ্যক গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারলেও পজেশনের দিক থেকে খুব একটা এগিয়ে থাকতে পারেনি তারা (৫৫-৪৫)। এলি সাবিয়া, পিটার হার্টলেদের মতো সফল ডিফেন্ডারদের বিরুদ্ধে একা সেম্বয় হাওকিপের তেমন অস্বাভাবিক কিছুই করার ছিল না। প্রথমার্ধের শেষ দিকে সেম্বয় গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করলেও যোগ্য সঙ্গতের অভাবে সফল হননি। প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে কর্নার থেকে জামশেদপুরের বরিস সিং হেডে গোল করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু বারের ওপর দিয়ে তা উড়ে যায়।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে আক্রমণের ধার আরও বাড়ায় ইস্পাতনগরীর দলের ফুটবলাররা। ৪৮ থেকে ৫২ মিনিটের মধ্যে পরপর দু’বার পজিটিভ সুযোগ তৈরি করে নেন তাঁরা। প্রথমবার একটি গোলমুখী সেন্টার ফিস্ট করে বার করে দেন অরিন্দম এবং তার তিন মিনিট পরেই জর্ডন মারের গোলমুখী হেড ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। বল থেকে তখন অনেকটা দূরেই ছিলেন গোলকিপার।

এই সময়েই চোট লাগে নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার আদিল খানের। সম্ভবত হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট তাঁকে ফের ভোগাতে শুরু করেছে। রেনেডি দায়িত্বে আসার পরে আদিলকে প্রথম এগারোয় রেখেছিলেন যে আশা নিয়ে, সেই আশা পূরণ করতে পারেন আদিল। দলের উজ্জীবিত রক্ষণ বিভাগকে নেতৃত্ব দেন তিনি। কিন্তু এই চোট তাঁকে আবার পিছিয়ে দিল। পুরোপুরি চোট সারিয়ে ফের কবে মাঠে নামতে পারবেন তিনি, সেটাই দেখার। আদিলের জায়গায় মাঠে নামেন ডাচ মিডফিল্ডার ড্যারেন সিডোল। তবে যথারীতি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি।

আদিল মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেই বিপক্ষের কোচ তাঁর দলের তরুণ স্ট্রাইকার ইশান পন্ডিতাকে নামান মাঝমাঠের খেলোয়াড় সেমিনলেন দুঙ্গেলের পরিবর্তে। আদিল-হীন ডিফেন্সকে আরও চাপে ফেলার উদ্দেশ্যেই যে এই সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ৬৫ মিনিটের মাথায় জর্ডান মারে বক্সের মাথা থেকে গোলে যে মাটিঘেঁষা শট নেন, তা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচান অরিন্দম। না হলে হয়তো তখনই এগিয়ে যেত জামশেদপুর।

অরিন্দমের এই দুর্দান্ত সেভের পরেই মহেশের জায়গায় অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড বলওয়ান্ত সিংকে নামান রেনেডি। আক্রমণে তাজা ভাব আনাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ৭১ মিনিটের মাথায় ডিফেন্ডার পিটার হার্টলেকে বসিয়ে মিডফিল্ডার অ্যালেক্স লিমাকে নামান কোইল। তবে ডিফেন্সের ফাঁক ভরাট করার জন্য নামান নরেন্দর গেহলটকেও। তাঁর জন্য তুলে নেন মিডফিল্ডার মোবাশির রহমানকে।

এই পরিবর্তনগুলির পরে বিপক্ষের ওপর আরও চাপ বাড়ায় জেএফসি। বেশির ভাগটাই মারে-কেন্দ্রিক। ৭৫ মিনিটের মাথায় বক্সের সামনে বাঁ দিক থেকে মাপা শট নেন মারে, যা তাঁর দ্বিতীয় পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে চলে যায়। ৮৫ মিনিটের মাথাতেও বক্সের মধ্যে থেকে গোলে শট নেন তিনি। কিন্তু বল অরিন্দমের হাতে জমা পড়ে যায়।

কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক দু’মিনিট আগে বাঁ দিক থেকে গ্রেগ স্টিউয়ার্টের মাপা কর্নারে নিখুঁত হেডে গোল করে দলকে বহু আকাঙ্খিত জয় এনে দেন ইশান পন্ডিতা। ছ’গজের বক্সের বাঁ দিকে এই হেড করার সময় ইশানকে মার্ক করছিলেন বলওয়ান্ত সিং। কিন্তু তিনি বলে নজর না রেখে ইশান্তকে আটকাতে গিয়েই ভুল করে বসেন। এই একটি ভুলেই তিন পয়েন্ট খোয়াতে হল অরিন্দমদের।

গোলের পরেই জর্ডান মারে এ দিন ছ’গজের বক্সের মাথায় ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে গোলে শট নেন, যা অসাধারণ দক্ষতায় আটকে দেন অরিন্দম। শেষ মিনিটে বল নিয়ে লাল-হলুদ বক্সে ঢুকে পড়েন স্টিউয়ার্ট। কিন্তু লাল-হলুদ ডিফেন্স তখনও তৎপর। তিন ডিফেন্ডার মিলিত ভাবে তাঁকে আটকে দেন। অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে এটাই সম্ভবত রেনেডির শেষ ম্যাচ। ১৯ জানুয়ারি এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ থেকে সম্ভবত দলের দায়িত্ব নেবেন নতুন হেড কোচ মারিও রিভেরা।