এনএফবি, পূর্ব মেদিনীপুরঃ
মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন হয় রক্ত। কখনো অপারেশনের জন্য বা কখনো শারীরিক বিভিন্ন কারণে রক্তাল্পতা দেখা দিলে মানব দেহে বাহ্যিক ভাবে রক্ত প্রবেশ করাতে হয় । কিন্তু রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে শরীর থেকে রক্ত বের করে দিতে হচ্ছে এক সদ্যোজাত শিশুর ৷ এমন ঘটনা একেবারে বিরল, যা ডাক্তারি ভাষায় বলা যেতে পারে লাখে এক জনের এমন অসুখ হয় ৷ যাকে বলা হয় (Polycythemia) পলিসাইথেমিয়া রোগ।
এই বিষয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কেলাঘাটের শিশু চিকিৎসক ডাঃ প্রবীর ভৌমিক জানান, গত ২০ বছরে এমন রোগাক্রান্ত ২ জন শিশুকে পেয়েছেন । এমনই এক সদ্যজাত শিশুপুত্রের চিকিৎসা চলছে কোলাঘাটের একটি বেসরকারী নার্সিংহোমে।
জানা গেছে, হাওড়া জেলার জয়পুর এলাকার বাসিন্দা উর্মিলা গুবড়ি গত ১৭ দিন আগে তমলুকের একটি নার্সিং হোমে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন । মাত্র দুদিনের মধ্যেই শ্বাসকষ্ট, হেঁচকি এবং হাতের শিরা ফুলে যাওয়া সহ একাধিক সমস্যায় পড়ে সদ্যজাড শিশুটি। প্রথমে সঠিক কি কারণে এই উপসর্গ ধরতে পারেনি চিকিৎসকেরা। এরপর তিন দিনের মাথায় কোলাঘাটের শিশু চিকিৎসক ডাঃ প্রবীর ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে ভর্তি হয় শিশুটি।এরপর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা দেখে রীতিমতো চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় চিকিৎসকের। দেখাযায় হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করে দেখাযায় তার মাত্রা ২৬।হিমোগ্লোবিন বেড়ে যাওয়ায় এই শ্বাসকষ্ট,খিঁচুনি এবং শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় । সাধারণ মানুষের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১২ এবং ছোট বাচ্চাদের ১৬- ১৮ থাকে । এরপর চিকিৎসা শুরু হয় সদ্যজাতের।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ।এককথায় ছোট্ট পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন জীবন দান করা হয় এই শিশুটিকে ।ব্যতিক্রমী রোগ এই পলিসাইথেমিয়া। বিরল রোগে আক্রান্ত নবজাতক শিশুকে সুস্থ করে আজ মায়ের কোলে তুলে দেওয়া হয় ।
ডাঃ প্রবীর ভৌমিক জানান,নবজাতক শিশুটি পলিসাইথেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলো। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন নতুন পরীক্ষার মধ্যে ছোট্ট একটা হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা নতুন মায়ের মুখে হাসি ফিরিয়ে দিল। বাচ্চাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। বর্তমানে কোলাঘাটের শুশ্রূষা শিশু সেবা নিকেতনে বাচ্চাটি চিকিৎসাধীন । রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় , শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা, গায়ের রং পরিবর্তন, সেই সঙ্গে শিরা-উপশিরায় রক্ত ফুলে ওঠা , প্রত্যেকটি উপসর্গই এই শিশুটির মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছিল ৷ শিশুটিকে পর্যবেক্ষণে রাখার পর সাধারণ হিমোগ্লোবিন পরীক্ষায় ধরা পড়ে বাচ্চাটির রক্তে রয়েছে ২৬ গ্রাম হিমোগ্লোবিন। সাধারণত একটি ছোট বাচ্চার শরীরে থাকে ষোল থেকে সতেরো গ্রাম হিমোগ্লোবিন। পিসিভি পরীক্ষা করার পর দেখা যায় বাচ্চাটির শরীরে রক্তের ঘনত্ব ৮৫ শতাংশ, যেখানে সাধারণ ভাবে থাকার কথা ৬০ থেকে ৬৫। যে পরিমাণ জল থাকার কথা তা না থাকার জন্যই শিশুটির শিরা-উপশিরা গুলো ফুলে যাচ্ছিল, রক্ত সঞ্চলন না হওয়ার জন্য শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল । সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাচ্চাটির হশরীর থেকে রক্ত বের করতে হবে। কয়েকদিন ধরে কিছু কিছু রক্ত বের করে প্রবেশ করা হয় লবণযুক্ত জল। আর তাতেই সাফল্য আসতে থাকে। বাচ্চাটির শরীরে প্রথমাবস্থায় যে ২৬ গ্রাম হিমোগ্লোবিন ছিল তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে অর্থাৎ ১৭ গ্রামে । সেই সঙ্গে আরও লক্ষ্য করা যায়, যে সমস্ত উপসর্গগুলি শিশুটির শরীরে ছিল তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে । দীর্ঘ চিকিৎসা জীবনে এরকম রোগীর সংখ্যা মাত্র দুটি পেয়েছেন বলে জানান তিনি । আমরা সাধারণত দেখি মানুষ কে রক্ত দিতে হয় এই শিশুটির শরীর থেকে রক্ত বের করতে হচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে রক্ত বের করে লবণ জল প্রবেশ করে শিশুর দেহে যে পরিমাণ হিমোগ্লোবিন থাকার কথা সেই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। শিশুটিকে সুস্থ করে তোলার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।
আরও জানা গেছে , শিশুটির মা উর্মিলা গুবড়ী তার সদ্যোজাত ছেলের নাম দিয়েছে কৃষ্ণ, কোলে ফিরে পেয়ে আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে তার চোখেমুখে। বাচ্চার নতুন জীবন পেয়ে ডাক্তারবাবুকে ভগবানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই সঙ্গে হাওড়া জেলার জয়পুরের বাড়িতে যখন খবর যায় এই সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে শুক্রবারে তাদের ছুটি দেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে পরিবারের লোকজন।