এনএফবি, ঝাড়গ্রামঃ
‘পৈড়ান’ সুবর্ণ রৈখিক অববাহিকা জঙ্গলমহলের একটি প্রাচীন লৌকিক উৎসব। কালীপুজোর পরের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আগের দিনে প্রায় সব গৃহস্থ কৃষক পরিবার বিশেষ করে সম্পন্ন কৃষক পরিবারের বাড়ীর সম্মুখ ভাগে সকালের দিকে ‘পৈড়ান গাড়া’ হতো, আর তা সাজানো হতো নানান ফুল দিয়ে আর লাগানো হতো ‘পিঠালী বাটা’ বা পিটুলী। অনেকটা লম্বা পাটের গোছাকে চুলের বিনুনী মতো করা হতো এবং সেটাকে মাথার দিকে গোলা করে মাটির নীচে ফুট তিনেক গর্ত করে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে পোঁতা বা গাড়া হতো।
কোথাও কোথায়ও পাশাপাশি দুটো একটি ছোট গর্ত আর একটি চাওড়া গর্ত করা হতো। তারপর চাওড়া গর্ত থেকে শক্ত কাঠের খিল ঠুকে ঠুকে মাটির নীচ দিয়ে ছোট গর্তে দিকে দেওয়া হতো আর এই ছোট গর্তেই কাঠের খিলের সঙ্গে বাঁধা হতো পাটের বিনুনি করা সেই মোটা দড়ি এবং গর্তগুলো খুব ভালো করে বোজানো হতো।বিকেলে গ্রামের যুবকরা আর ক্ষেতমজুররা শাল বল্লি বা শক্ত বাঁশের সাহায্যে সেই পাটের বিনুনীকে মাটির তলা থেকে তুলতেন আর বাজতে থাকত কডা…নাকড়া..মাদল..ঢোলের মতো নানা রকম বাদ্যযন্ত্র আর কান ফাটানো “কুয়াকুলি”। যে বা যাঁরা পৈড়ান তুলতেন তাঁদের জন্য থাকতো পুরস্কার। যার বেশিরভাগটা খাদ্যদ্রব্য। প্রবীণদের স্মৃতি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোন কোন সম্পন্ন কৃষক পুরস্কার হিসাবে খাসি বেঁধে রাখতেন। আবার বিনুনী ছিঁড়ে গেলে যিনি পুঁতেছেন তাঁকে “জরিমানা” হিসাবেও খাওয়াতে হতো পৈড়ান তোলার দলকে। পাটের পরিবর্তে কোথায়ও কোথাও বাঁশের কঞ্চি বা বনের শক্ত লতাকেও ব্যবহার করা হতো।
দিন বদলেছে, বদলেছে উৎসবের ধরণ ও জৌলুস।এখন নাম কা ওয়াস্তে কোথায়ও কোথায়ও গ্রামের মোড়ে ছেলে ছোকরারারা নিজ উদ্যোগে ‘পৈড়ান’ গাড়েন এবং তোলেন। কারও কারও মতে পৈড়ান আসলে বলি দৈত্যরাজ পূজার অঙ্গ।
এবছর বিশ্বজিৎ পালদের মতো কিছু উৎসাহী যুবকের উদ্যোগে গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের জুনশোলা গ্রামে পৈড়ান অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও গোপীবল্লবপুর-১ ও ২ ব্লক, সাঁকরাইল, নয়াগ্রাম ব্লকের অল্প কিছু জায়গায় পৈড়ান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
লোকসংস্কৃতি বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু শিক্ষক সুদীপ কুমার খাঁড়া’র মতে, কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এবং গ্রামীণ সভ্যতার শেকড়ের সাথে জড়িত এই উৎসব গুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।