অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ
লিগ টেবলের শীর্ষে থাকা হায়দ্রাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে রীতিমতো দাপুটে পারফরম্যান্সের পর তাদের ২-১-এ হারাল গতবারের রানার্স-আপ এটিকে মোহনবাগান। এ দিন ম্যাচের বয়স ৩০ মিনিট হতে না হতেই তাদের দুই নির্ভরযোগ্য তারকা হুগো বুমৌস ও কার্ল ম্যাকহিউ চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়া সত্ত্বেও সারা ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করে কলকাতার দল। হিরো আইএসএলে হাবিব-আকবরদের শহরের দলের বিরুদ্ধে এই প্রথম জয় সবুজ-মেরুনের।
দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র চার মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল করে দলকে এগিয়ে দেন যথাক্রমে লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং। এর দশ মিনিটের মধ্যে একটি গোল শোধ করেন হায়দ্রাবাদের ফরোয়ার্ড জোয়েল চিয়ানিজ। ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে কোলাসো পরপর দু’টি গোল অবিশ্বাস্য ভাবে মিস না করলে ম্যাচটা হয়তো ৪-১-এ জিততে পারত এটিকে মোহনবাগান। প্রাক্তন ক্লাবের বিরুদ্ধে এ দিন দুরন্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে ম্যাচের সেরার খেতাব জিতে নেন তিনি।
এই জয়ের ফলে ১৩ ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে তিন ধাপ লাফিয়ে সেরা চারে ফিরে এল তারা। শীর্ষে থাকা হায়দ্রাবাদের সঙ্গে তাদের এখন মাত্র তিন পয়েন্টের ফারাক। তার ওপর হায়দ্রাবাদের চেয়ে দু’টি ম্যাচ কম খেলেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সেরা চারের অন্য দুই দলেরই (কেরালা ও বেঙ্গালুরু) সংগৃহিত পয়েন্ট এখন ২৩।
এ দিন দু’পক্ষই একই ছকে দল সাজায় ৪-২-৩-১। কিন্তু প্রথম ৪৫ মিনিট খেলাটা কার্যত একপেশেই হয়। শুরুর ২০ মিনিটেই এটিকে মোহনবাগান বুঝিয়ে দেয় জয় ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না এ দিন। এই সময়ে বুমৌস বক্সের মধ্যে থেকে পরপর দু’টি গোলমুখী শট নেন, যার প্রথমটি সাইড নেটে লাগে ও পরেরটি সেভ করেন গোলকিপার লক্ষ্মীকান্ত কাট্টিমনি। সারা ম্যাচে পজিশনেও আধিপত্য বিস্তার করে রাখে এটিকে মোহনবাগান (নীচের পরিসংখ্যান দেখুন)।
হায়দ্রাবাদ এফসি তাদের প্রথম পজিটিভ সুযোগটি পায় ২৪ মিনিটের মাথায়, যখন ‘গোলমেশিন’ বার্থোলোমিউ ওগবেচে মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বল বক্সের মধ্যে থেকে সোজা গোলে শট নেন। কিন্তু অমরিন্দরের পাশে থাকা শুভাশিস তা ব্লক করে দেন। শুভাশিস ওই জায়গায় না থাকলে অবধারিত ভাবে হিরো আইএসএলের ৫০তম গোলটি পেয়ে যেতেন ওগবেচে। এ দিন ওগবেচেকে সারা ম্যাচে আর একটিও গোলে শট নিতে দেননি সবুজ-মেরুন ডিফেন্ডাররা। রীতিমতো বোতলবন্দী করে রেখেছিলেন নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকারকে। তবে তাঁর সতীর্থরা একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করে। ৩০ মিনিটের মাথায় নিখিল পূজারির দূরপাল্লার শট অমরিন্দরের হাতে লেগে বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।
কিন্তু এর পরেই প্রায় একসঙ্গে দু-দু’টি বড় ধাক্কা খায় এটিকে মোহনবাগান। কুঁচকির চোটের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন হুগো বুমৌস। তাঁর জায়গায় নামেন জনি কাউকো। এই ঘটনার পরেই নিখিল পূজারি ডানদিক দিয়ে উঠে অনিকেত যাদবের উদ্দেশ্যে দুর্দান্ত একটি মাইনাস করেন। অনিকেত গোলে শট নিলেও তা ব্লক করে দেন প্রীতম কোটাল। পূজারিকে বাধা দিতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান কার্ল ম্যাকহিউও এবং বুমৌসের পাঁচ মিনিট পরে তিনিও মাঠের বাইরে চলে যান। কার্লের জায়গায় নামেন ডার্বিতে হ্যাটট্রিকের নায়ক কিয়ান নাসিরি।
দলকে আশ্বাস দিতে কাউকো ৪০ মিনিটের মাথায় বিপক্ষের বক্সের বাইরে থেকে সোজা গোলে শট নেন যা সোজা কাট্টিমনির হাতে গিয়ে ধাক্কা খায়। পরের মিনিটেই মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে বক্সের বাইরে থেকে কাউকোর মতোই একটি শট নেন কোলাসো, যা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে সেভ করেন হায়দ্রাবাদি গোলকিপার। বুমৌস ও ম্যাকহিউ বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যে তাঁরা মানসিক ভাবে পিছিয়ে যাননি, এই দুই শটেই ছিল তার স্পষ্ট সঙ্কেত।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই জোড়া পরিবর্তন করে হায়দ্রাবাদ। পূজারির জায়গায় মিডফিল্ডার ইয়াসির মহম্মদ ও অনিকেতের জায়গায় ফরোয়ার্ড রোহিত দানু। এই দুই পরিবর্তনই এ দিন বেশ চাপে রাখেন বিপক্ষের রক্ষণকে। ওগবেচেকে বোতলবন্দী হতে দেখেই সম্ভবত আক্রমণে ধার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই পরিবর্তনগুলি করেন কোচ মানোলো মার্কেজ।
তরুণ ফরোয়ার্ড রোহিত শুরুতেই চমক দেন ফ্রিকিক থেকে পাওয়া বলে দুর্দান্ত গোলমুখী ভলি মেরে, যা বারে লেগে গোললাইনের এ পারে ড্রপ করে। ইয়াসিরকে বক্সের সামনে প্রবীর ফাউল করায় এই ফ্রিকিক পায় হায়দ্রাবাদ।
প্রথমার্ধে এটিকে মোহনবাগান যে জায়গাটায় পিছিয়ে ছিল, সেই জায়গাটায় উন্নতি করতেই চার মিনিটের মধ্যে পরপর দু-দু’টি গোল পেয়ে যায় এটিকে মোহনবাগান। তা হল উইং প্লে। প্রথম গোলটি বাঁ উইং দিয়ে ওঠা লিস্টন কোলাসো পান ৫৬ মিনিটের মাথায় ও তার তিন মিনিট পরেই ডানদিক দিয়ে উঠে গোল করেন মনবীর।
প্রথম গোলের ক্ষেত্রে নিজেদের অর্ধ থেকে কোলাসোকে যখন লম্বা পাস বাড়ান ডেভিড উইলিয়ামস, তখন হায়দ্রাবাদের কোনও খেলোয়াড় ছিলেন না তাঁকে আটকানোর জন্য। বল নিয়ে বক্সে ঢুকে যখন গোলে কোণাকুণি শট নেন কোলাসো, তখন অবশ্য তাঁকে বাধা দিতে গোলকিপার ও চার ডিফেন্ডার বক্সে চলে আসেন। কিন্তু তাঁদের পরাস্ত করে মধ্যগতির ইনসুইঙ্গারে বল গোলে রাখেন গোয়ানিজ ফরোয়ার্ড (১-০)।
মনবীরকে গোলের বল সাজিয়ে দেন কাউকো। সেন্টার লাইন পেরিয়ে তিনি ডান দিক দিয়ে ওঠা মনবীরকে হাওয়ায় ভাসানো পাস দেন, যা লাফিয়ে উঠে রিসিভ করেন পাঞ্জাবী ফরোয়ার্ড। এর পরেই ইনসাইড কাট করে বক্সে ঢুকে বাঁ পায়ে সোজা গোলে শট নেন তিনি (২-০)। চারজন ডিফেন্ডার ঘিরে থাকা সত্ত্বেও তাঁকে আটকাতে পারেননি কেউই। দু-গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরই ডেভিড উইলিয়ামসকে তুলে নেন কোচ ফেরান্দো।
এই দুই গোলের মাঝখানে আরও একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান রোহিত। কিন্তু গোলের সামনে থেকে নেওয়া তাঁর হেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তবে গোলের জন্য মরিয়া হায়দ্রাবাদ এফসি-র প্রথম গোল শোধ করতে বেশিক্ষণ লাগেনি। ৬৭ মিনিটের মাথায় ওগবেচের ক্রস থেকে গোলে শট নেন জোয়াও ভিক্টর। তা অমরিন্দরের হাতে লেগে ছিটকে যায়। ফিরতি বলে ফের গোলের মতো শট নেন বক্সের মধ্যে থাকা জোয়েল চিয়ানিজ। এ বার অমরিন্দর সেভ করতে পারেননি (২-১)।
প্রথম গোলটি শোধ করার পরেই সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে হায়দ্রাবাদ। ৭০ মিনিটের মাথায় ওগবেচের হেড বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ৭৭ মিনিটে ইয়াসিরের পাস থেকে সময় নিয়ে গোলে শট নেন প্রায় ফাঁকায় থাকা রোহিত। কিন্তু অমরিন্দর দুর্দান্ত সেভ করেন। এই দুই আক্রমণের মধ্যে ৭৫ মিনিটের মাথায় জোয়াও ভিক্টরকে তুলে ‘সুপারসাব’ হাভিয়ে সিভেইরোকে নামান মার্কেজ। প্রথম লেগের ম্যাচে এই সিভেইরোর স্টপেজ টাইমের গোলেই এটিকে মোহনবাগানের জয় আটকে গিয়েছিল। তবে এ দিন তিনি সেই ঘটনা ফের ঘটাতে পারেননি।
এই সময়ে এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণ যেমন নিজেদের অঞ্চলে প্রায় দেওয়াল তুলে দেয়, তেমনই কাউন্টার অ্যাটাকেও ওঠে দ্রুত গতিতে। ৮৫ মিনিটের মাথায় গোলের সামনে থেকে যে গোল মিস করেন কোলাসো, তাকে অবিশ্বাস্য বলাই যায়। কোলাসোর কাছ থেকেই পাওয়া বল তাঁকে গোলের সামনে ফিরিয়ে দেন কিয়ান নাসিরি। কিন্তু গোলের প্রায় ৫ গজ দূর থেকে সাইড নেটে মারেন ম্যাচের নায়ক। স্টপেজ টাইমে মাঝমাঠ থেকে কিয়ানের অসাধারণ ও মাপা পাস নিয়ে বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে গোলে কোণাকুণি শট নেন ফের সেই কোলাসো, কিন্তু এ বারেও তাঁর শট বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বাড়তি ছ’মিনিটে পরপর কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত দেখা যায়। বেশির ভাগই সবুজ-মেরুন শিবিরের পক্ষে, যেগুলো কাজে লাগাতে পারলে তিন বা চার গোল দিয়ে শেষ করতে পারত তারা। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের একাধিক ভুলে ব্যবধান বাড়াতে পারেনি গতবারের রানার্স আপ-রা।
এটিকে মোহনবাগান দলঃ অমরিন্দর সিং (গোল), তিরি, শুভাশিস বোস, প্রীতম কোটাল (অধি), প্রবীর দাস, কার্ল ম্যাকহিউ (কিয়ান নাসিরি), লেনি রড্রিগেজ, ডেভিড উই টাঙরি), হুগো বুমৌস (জনি কাউকো), মন