অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ
মণিপুর থেকে উঠে আসা তরুণ ফরোয়ার্ড নাওরেম মহেশ সিংয়ের জোড়া গোল জয়ে ফেরাল এসসি ইস্টবেঙ্গলকে। বুধবার সন্ধ্যায় বাম্বোলিমে প্রথমার্ধে করা দু’টি সুযোগসন্ধানী গোলে দলকে বহুকাঙ্খিত জয় এনে দেন শিলং-লাজং এফসি থেকে উঠে আসা ফরোয়ার্ড। চলতি লিগের ১২ নম্বর ম্যাচে ২-১ জয় পেল লাল-হলুদ বাহিনী।
এ দিনই ক্লাবের নতুন স্প্যানিশ কোচ মারিও রিভেরার প্রশিক্ষণে প্রথম মাঠে নামে এসসি ইস্টবেঙ্গল। এর আগে যে ভাবে হিরো আই লিগের মাঝপথে দলের হাল ধরে দুই নম্বরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, বুধবার সে ভাবেই তাঁর আইএসএল অভিযান শুরু করলেন রিভেরা। দুই মরশুমের হিসেব ধরলে টানা ১৫ ম্যাচ পরে জয়ের আনন্দে মাতার সুযোগ পেলেন ক্লাবের সমর্থকেরা। সময়ের হিসেবে প্রায় সাড়ে ১১ মাস পরে এই জয় পেল তাদের প্রিয় ক্লাব।
এ দিন ৯ মিনিটের মাথায় দুর্দান্ত গোল করে দলকে এগিয়ে দেন মহেশ। ৩৭ মিনিটের মাথায় আলবার্তো নগুয়েরা সমতা আনলেও তার পাঁচ মিনিট পরেই ফের গোল করে দলকে এগিয়ে দেন সেই মহেশই। দু’টি গোলই প্রতিপক্ষের অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে করেন মহেশ। এমন প্রখর সুযোগসন্ধানী গোল করতে বড় একটা দেখা যায় না ভারতীয়দের। তবে মহেশ দেখিয়ে দিলেন, ভারতীয়রাও পারেন। চলতি লিগের প্রথম জয় কলকাতার দলকে একধাপ ওপরে, ১০ নম্বরে তুলে দিল। পঞ্চম হারের ফলে এফসি গোয়া যেখানে ছিল, সেই নয় নম্বরেই রয়ে গেল।
৯ মিনিটঃ মহেশের গোল। নগুয়েরা ও এডু বেদিয়ার মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়ার মাঝখান থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে বক্সে ঢুকে দুর্দান্ত সাহসিকতা দেখিয়ে বাঁ পায়ে গোলে শট নেন মহেশ।
৩৭ মিনিটঃ বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওর্টিজের বক্সের মধ্যে বাড়ানো থ্রু থেকে গোল করে সমতা আনেন নগুয়েরা।
৪২ মিনিটঃ মহেশের দ্বিতীয় গোল। নিজেদের এলাকায় সতীর্থকে লম্বা পাস বাড়াতে যান আনোয়ার, তা মাঝপথে ছিনিয়ে নেন মহেশ ও বক্সের মাথা থেকে ফের জোরালো শটে গোল করেন।
এ দিন ৪-৩-৩ ছকে দলকে সাজান এসসি ইস্টবেঙ্গলের নতুন কোচ মারিও রিভেরা। সামনে অধিনায়ক মহম্মদ রফিক, নাওরেম মহেশ ও সেম্বয় হাওকিপকে রাখেন তিনি। অঙ্কিত, পর্চে, আদিল ও অমরজিৎকে নিয়ে তৈরি করেন ব্যাকলাইন। হীরা মন্ডল এ দিন স্কোয়াডে ছিলেন না। পর্চে ছাড়াও এ দিন ড্যারেন সিডোল প্রথম এগারোয় রাইট হাফ হিসেবে নামেন।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এফসি গোয়ার আধিপত্য থাকলেও (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন) যথারীতি লাল-হলুদের জমাট বাঁধা ডিফেন্সে আটকে যায় তারা। পজিশনও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোয়ার ফুটবলারদেরই বেশি দেখা যায় (৬৫%)। কিন্তু ৯ মিনিটে দেওয়া নাওরেম মহেশের আচমকা গোলে তারা সমস্যায় পড়ে যায়।
নিজেদের এলাকায় আলবার্তো নগুয়েরা ও এডু বেদিয়ার মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়ার মাঝখান থেকে বল ছিনিয়ে নেন মহেশ। একাই বল নিয়ে বক্সে ঢুকে দুর্দান্ত সাহসিকতা দেখিয়ে বাঁ পায়ে গোলে শট নেন তিনি। আকস্মিক এই আক্রমণে হতভম্ব এফসি গোয়ার গোলকিপার ধীরজ সিংয়ের তখন আর কিছুই করার ছিলনা।
ম্যাচের দশ মিনিটের মধ্যে গোল খেয়ে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এফসি গোয়া। ঘন ঘন আক্রমণে উঠতে শুরু করেন নগুয়েরা, কাবরেরা, ওর্টিজরা। পিছন থেকে তাঁদের গোলের বল সাপ্লাই দেন এডু বেদিয়া। ২০ মিনিটের মাথায় এমনই এক আক্রমণে উঠে ওর্টিজ বক্সের মধ্যে লো ক্রস দেন বেদিয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই বলে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন বেদিয়া। ৩৪ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওর্টিজ ফের ক্রস দেন রোমারিওকে। এ বারেও তিনি বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি।
যে ভাবে ওর্টিজকে জায়গা দিচ্ছিলেন লাল-হলুদ ডিফেন্ডাররা, তাতে তিনি প্রায়ই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন। এখানে ওর্টিজকে কড়া পাহাড়ায় রাখার প্রয়োজন ছিল। এই কাজটাই করতে না পারার মাশুল এসসি ইস্টবেঙ্গলকে দিতে হয় ৩৭ মিনিটের মাথায়। বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওর্টিজের বাড়ানো থ্রু পেয়ে বক্সের মধ্যে থেকে গোল করে সমতা আনেন নগুয়েরা। ওর্টিজ ও নগুয়েরার মাঝখানে এসেও বল ক্লিয়ার করে পারেননি আদিল খান।
সমতা আনার পরে চাপ আরও বাড়ায় এফসি গোয়া। ব্যবধান তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। ৪০ মিনিটের মাথায় কর্ণার থেকে হেডে গোল করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান আনোয়ার আলি। তিনি ঠিকমতো মাথায় ছোঁয়াতে পারলে হয়তো ব্যবধান তৈরি করে নিতে পারত গোয়া। কিন্তু তা পারেননি এই অনভিজ্ঞ তরুণ ডিফেন্ডার। কিছুক্ষণ পরেই যে তাঁর ভুলের মাশুল দিতে হবে দলকে, তখন তা জানতেন না তিনি।
৪২ মিনিটের মাথায় ফের যে কাণ্ডটা করে বসেন এসসি ইস্টবেঙ্গলের গোলের নায়ক সেই নাওরেম মহেশ, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। নিজেদের এলাকায় সতীর্থকে যে লম্বা পাস বাড়াতে যান আনোয়ার, তা আবার মাঝপথে ছিনিয়ে নেন শিলং লাজংয়ের এই প্রাক্তন ফরোয়ার্ড। বক্সের মাথা থেকে ফের জোরালো শট নেন আত্মবিশ্বাসী মহেশ এবং তা ক্রসবারের নীচের অংশে লেগে গোললাইনের ওপারে ড্রপ খায়। ফের এফসি গোয়ার ডিফেন্সের অসাবধানতা কাজে লাগিয়ে ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটা পেয়ে যান সুযোগসন্ধানী মহেশ।
বিরতির পরে অধিনায়কের ব্যান্ড আদিলকে দিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যান মহম্মদ রফিক। তাঁর জায়গায় নামেন রাজু গায়কোয়াড়। রফিকের জায়গায় চলে আসেন অমরজিৎ এবং তাঁর জায়গায় চলে যান রাজু।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ফের সমতা আনার সুযোগ পেয়ে যায় এফসি গোয়া। এসসি ইস্টবেঙ্গলের বক্সের ঠিক সামনে ফ্রি কিক পেয়ে যায় তারা। সেই ফ্রি কিক থেকে এডু বেদিয়া সোজা গোলে শট নিলে বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা দুর্দান্ত দক্ষতায় সেভ করেন গোলকিপার অরিন্দম।
এর পর থেকেই ক্রমশ নিজেদের এলাকায় পাহাড়া বাড়াতে শুরু করে এসসি ইস্টবেঙ্গল। রেনেডি সিং যে ভাবে দলের রক্ষণকে সঙ্ঘবদ্ধ করার পথে নিয়ে এসেছিলেন, ক্রমশ সেই পথে চলে আসে তারা। এফসি গোয়া বারবার আক্রমণের পথে আটকে যাওয়ায় ক্রমশ হতাশ হতে শুরু করেন গোয়ার ফুটবলাররা।
৭০ মিনিটের মাথায় হাওকিপকে বসিয়ে বলওয়ান্তকে নামান রিভেরা। তার পাঁচ মিনিট পরেই মহেশের জায়গায় নামেন জ্যাকিচন্দ সিং। আক্রমণ বিভাগে পরিবর্তন করলেও এই সময়ে রক্ষণেই পুরোপুরি মনোনিবেশ করে লাল-হলুদ শিবির। এর মধ্যেই ৭৭ মিনিটের মাথায় বলওয়ান্ত বল নিয়ে বিপক্ষের গোল এরিয়ায় সামনে অনেকটা জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন এবং অফসাইড ট্র্যাপও ভেঙে ফেলেন তিনি। কিন্তু বক্সের মধ্যে দেওয়া তাঁর ক্রস ব্লক করে দেন লিয়েন্ডার ডিকুনহা।
ম্যাচের শেষ দিকে এসসি ইস্টবেঙ্গল নিজেদের যতটা রক্ষণে গুটিয়ে নেয়, ততটাই চাপ বাড়ায় এফসি গোয়া। সাত মিনিটের যে স্টপেজ টাইম দেওয়া হয়, সেই সময়ে গোয়ার আক্রমণ ও লাল-হলুদের রক্ষণের লড়াই ওঠে চরমে। কিন্তু সেই লড়াইয়েও সফল হতে পারেনি এফসি গোয়া। ফলে লিগের প্রথম জয়ের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে যান লাল-হলুদ সমর্থকেরা।