চিরঞ্জিৎ সাহা
সালটা ২০০৪। বছর ছয়েক পথ চলতে না চলতেই লোকসভা নির্বাচনে রীতিমতো ভরাডুবি। রাতারাতি সাত থেকে আসনসংখ্যা নেমে এল একে। বাংলা জুড়ে প্রতিটি আসনে পরাস্ত তৃণমূল কংগ্রেস। ব্যতিক্রম কেবল শিবরাত্রির সলতে হয়ে জ্বলতে থাকা দক্ষিণ কলকাতা। গোটা বাংলায় ঘাসফুল ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেলেও নিজের গড় সেদিন টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায়। এরপর ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন। রক্তক্ষরণ অব্যাহত মাত্র আট বছরের দলটার। কোনোক্রমে তিরিশটা আসন নিয়ে বরাতজোরে টিকেছিল বিরোধী দলের তকমা। কিন্তু ট্যুইস্টটা ঠিক এরপরেই। মিডিয়ার সমস্ত বুথ ফেরত সমীক্ষাকে নিছক রসিকতায় পরিণত করে ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে উনিশটি আসনে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস। অর্থাৎ মাত্র পাঁচবছরের ব্যবধানে রাজনৈতিক আঙিনায় হামাগুড়ি দিতে থাকা এগারো বছরের একটা আঞ্চলিক দল ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় ভর করে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তা বিস্মিত চোখে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হল তাবড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। প্রায় তিন যুগ পেরিয়ে আসার পর বামফ্রন্টের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার সাহস পেল এই বাংলা। সৌজন্যে কালীঘাটের বছর চুয়ান্নের এক ভদ্রমহিলা। তৎকালীন সরকারবিরোধী যে কোনো আন্দোলনে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়তে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। বিরোধিতার আগুনকে সমাজের সর্বস্তরে সঞ্চারিত করার দুরূহ কর্মযোগ্যে ছিলেন আপসহীন। ফল ২০১১ সালে ছয়গুণেরও বেশি আসন বৃদ্ধি করে ৩০ থেকে একলাফে ১৮৭টি আসন নিয়ে বাংলার মানুষের মনের মসনদে…ওয়ান ম্যান আর্মি কিংবা একক দক্ষতায় ভাস্বর হয়ে ওঠার এমন নিদর্শন বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক অতীতে আর কোথায়!
কাট টু মুর্শিদাবাদ। প্রবাদবলে তিনি বহরমপুরের “ বেতাজ বাদশা”। ১৯৯৯ থেকে পাঁচবারের সাংসদ। তাও আবার ভারতবর্ষের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের টিকিটে। সাথে বর্তমান জাতীয় কংগ্রেসের লোকসভার পরিষদীয় দলনেতা অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতিতে ব্যক্তিগত কৃতিত্বের খতিয়ানে খুব একটা পিছিয়ে নেই তিনিও। অথচ, বর্তমান সর্বভারতীয় রাজনীতির দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের পাঁচবারের সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও নিজের প্রতাপ মুর্শিদাবাদের বাইরে ছড়িয়ে দিতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ। রাজনৈতিক যাবতীয় তরজাকে দূরে সরিয়ে রেখেই বলতে হয় কালীঘাটের নেত্রীর মতো চটিপায়ে গোটা রাজ্যে চরকিপাক তার ধাঁতের বাইরে। লোকসভায় জাতীয় কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা কিংবা পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানের মত হেভিওয়েট পদ হাতে থাকা সত্ত্বেও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ সংগঠিত করতে দেখা যায় না তাঁকে। উপরন্তু ২০২০ সালে অধীররঞ্জন চৌধুরি প্রদেশ সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ রাজ্যে কংগ্রেস পরিণত কার্যত সাইনবোর্ডে। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনই প্রমাণ যে অধীর সম্পর্কে “যত বিস্তার বহরমপুর”-এ বলার দিনও এখন অতীত। গোটা মুর্শিদাবাদ জুড়ে হাত ধুয়েমুছে পুরোপুরি সাফ। সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, জেলার ২০ টি বিধানসভা কেন্দ্রের ১৮ টি শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও ২ টি বিজেপির দখলে। নিজের শহরেই পরাজিত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরি। সুতরাং, লোকসভায় ডাবল হ্যাটট্রিকে পথে এগিয়ে চলা অধীর বিধানসভায় নিজের শহরেই গড় টেকানোর লড়াইয়ে রীতিমতো ধরাশায়ী। হয়তো তার কাছে প্রতীকের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় পদ। তাই ব্যক্তিগত স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে মরিয়া হলেও জেলা বা রাজ্যে ভেন্টিলেশনে থাকা দলকে অক্সিজেন জোগানোর লড়াইয়ে তিনি নিষ্প্রভ। উপরন্তু এ রাজ্যে তাঁর জমানাতেই কংগ্রেস ফসিলস হওয়ার পথে। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সারদা কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত তৃণমূল কর্মীদের মনোবল জোগাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রকাশ্য সভায় জোর গলায় বলেছিলেন — “২৯৪ টি আসনে আমিই প্রার্থী। আমায় ভোট দিন।” সামনে এসে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের এমন সাহস অধীর চৌধুরি আর কবে দেখাবেন!
এহেন পোড়খাওয়া, সাংগঠনিকভাবে দেউলিয়াগামী রাজনীতিবিদ হঠাৎ প্রকাশ্য মঞ্চে হাস্যকরভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে চেয়ে বসলেন এমন একজনকে , হাইকোর্টে যার এজলাসে একাধিক সরকারবিরোধী মামলা। পূর্বেও যার হাত ধরে বেশ কিছু রায় এসেছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসকদলের বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায় অধীরবাবুর এরূপ শিশুসুলভ মন্তব্যে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দানাবাঁধা খুবই বাস্তবিক নয় কী! এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে অধীররঞ্জন চৌধুরি কী আদতে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে মহিমান্বিত করতে চাইলেন নাকি ইতিমধ্যেই একশ্রেণির চোখে ঈশ্বর বনে যাওয়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে এহেন চটকদার প্রশংসার ফাটকা তাস খেলে নিজের ঝিমন্ত রাজনৈতিক কেরিয়ারে আনতে চাইলেন নতুন গতি! যে মুর্শিদাবাদ বছরতিনেক আগে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছিল কংগ্রেসকে, তারা যে সামনের লোকসভা নির্বাচনে আবারও অধীরবাবুকে জেতাবেন — এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না তাঁর অতি বড়ো সমর্থকও। তাই ডোবার আগে শেষ খড়কুটো হিসেবে হয়তো অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে আঁকড়ে ধরতে চাইলেন অধীর। মুখ্যমন্ত্রিত্বের বিধানসভা নির্বাচন এখনও বছর আড়াই বাকি। তার আগে তবে একবার অন্তত হয়ে যাক অভিজিৎবাবুর অ্যাসিড টেস্ট। বিচারপতির পদে ইস্তফা দিয়ে বহরমপুর কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে। তাঁর গুণমুগ্ধ অধীররঞ্জন চৌধুরি বাংলার মানুষের স্বার্থে ছেড়ে দিন পাঁচবারের জেতা আসন। বছরতিনেক আগে নিজের কমফোর্ট জোন ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কিন্তু নন্দীগ্রামের মতো কঠিন সিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাহস দেখিয়েছিলেন। এবার নিজের স্বপ্নের মুখ্যমন্ত্রীকে রাজনৈতিক ময়দানে অভিষিক্ত করতে নিজের জেতা আসন উপহার দিয়ে সেই পথেই সওয়ার হওয়ারই কী নজির গড়বেন “বহরমপুরের বেতাজ বাদশা”? নিজেকে সরিয়ে নেবেন অন্য কোনো আসনে? কিংয়ের চেয়ে কিং মেকার হতে কলজের জোর লাগে অনেক বেশি। আসলে মনের ম্যাপে ইচ্ছা আর সদিচ্ছার দূরত্ব অনেকটাই কিনা…..
( নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)