অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ
ভারতীয় ফুটবলে সুনীল ছেত্রীর পর গোল করার লোক কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যখন প্রায় হিমশিম খাওয়ার অবস্থা এ দেশের ফুটবলপ্রেমীদের, হাতের সামনে কাউকে না পেয়ে তারা যখন দিশাহারা, তখনই এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এল ইন্ডিয়ান সুপার লিগ।
অনেকে যুক্তি দিতে পারেন, আইএসএলের বেশিরভাগ গোলস্কোরারই তো বিদেশি। এই পজিশনে ভারতীয় ফুটবলারদের খেলতে দেখা যায়ই বা কোথায়? বিদেশি কোচেরাও তো ভারতীয় ফরোয়ার্ডদের ওপর খুব একটা ভরসা করেন না। তা হলে আর গোল করার লোক তৈরি হবে কী করে?
তাঁদের জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রবিবারের ম্যাচের শেষে এ বারের আই লিগের সেরা গোলস্কোরারদের তালিকায় প্রথম পাঁচে রয়েছেন একজন ভারতীয়। তিনি এটিকে মোহনবাগানের লিস্টন কোলাসো। সাতটি ম্যাচে যাঁর গোলসংখ্যা চার।
গতবার সুনীল ছেত্রী ছাড়া আর কোনও ভারতীয় এই তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে জায়গা পাননি। এ বার লিগের অষ্টম রাউন্ড শেষ হতে চলেছে। প্রথম পাঁচে যেমন রয়েছেন কোলাসো, তেমনই প্রথম দশে রয়েছেন কেরালা ব্লাস্টার্সের ভারতীয় তারকা সাহাল আব্দুল সামাদ। ইঙ্গিতটা আর যাই হোক, খারাপ নয়। ভারতীয় ফুটবলে স্কোরার তৈরি না হলে আর জাতীয় দল সফল হবে কী করে? গোলই তো ফুটবলে শেষ কথা।
গত মরশুমে হায়দ্রাবাদ এফসি-র হয়ে মাঠে নেমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর আসন্ন মরশুমের জন্য রেকর্ড ট্রান্সফার ফি (কোনও ভারতীয় ফুটবলারের ক্ষেত্রে) দিয়ে তাঁকে নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসে এটিকে মোহনবাগান। গতবার হায়দ্রাবাদ এফসি-র হয়ে ১৯টি ম্যাচ খেলেন কোলাসো। দু’টি গোল করেন ও তিনটিতে অ্যাসিস্ট করেন। তার আগের তিন মরশুমে ১২টি ম্যাচ খেলে দু’টি গোল করেন তিনি। আইএসএলে যে মোট আটটি গোল রয়েছে তাঁর, তার মধ্যে চারটিই এ বারে। আরও গোল হয়তো পাবেন।
২৩ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড এবারের লিগে যে চারটি গোল তিনি পেয়েছেন, চারটিই স্মরণীয়। এবার প্রথম ম্যাচ থেকেই গোল পাচ্ছেন তিনি। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচের ৫০ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি বক্স থেকে রয় কৃষ্ণা ব্যাক পাস করেন কোলাসোকে। বক্সের মাথা থেকে ঠাণ্ডা মাথায় কোলাসোর পায়ের হালকা টোকায় দ্বিতীয় পোস্টের দিকে ভাসানো বল গতিপথ সামান্য বদলে গোলে ঢুকে যায়। গোলকিপার ডাইভ দিলেও তাঁর কিছু করার ছিল না।
কলকাতা ডার্বিতে ২৩ মিনিটের মাথায় তাঁর গোলেই এটিকে মোহনবাগান জয়ের হদিশ পেয়ে যায়। প্রথমে মাঝমাঠ থেকে কোলাসোকে নিখুঁত বল বাড়িয়েছিলেন হুগো বুমৌস। বাঁ দিক দিয়ে ওঠা গোয়ানিজ ফরোয়ার্ডকে বক্সের ডান দিকে এসে আটকাতে যান বিপক্ষের গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্য। কোলাসো বল পাওয়ার আগেই অরিন্দম তা কেড়ে নিলেও সেই বল তাঁর হাত ফস্কে বেরিয়ে যায় এবং সেই সুযোগ দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়ে গোলে কোণাকুণি শট নেন কোলাসো।
চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে তাঁর গোলটিও ছিল অনবদ্য। মাঝমাঠ পেরিয়ে রয় কৃষ্ণার অসাধারণ লম্বা পাসই ছিল সেই গোলের উৎস্য। বিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে ঠেলা বল পান বাঁ দিকের উইং দিয়ে ওঠা কোলাসো। বক্সে ঢুকে কোণাকুণি শটে বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি। বল ক্রসবারের নীচে ধাক্কা খেয়ে গোলে ঢুকে যায়।
তবে গত মঙ্গলবার নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে যে গোলটি করেন তিনি, সেটা এখন পর্যন্ত সেরা। বিরতিতে যাওয়ার মিনিট খানেক আগে কোলাসোর অসাধারণ হেডে করা এই গোলেই সমতা এনে ফেলে এটিকে মোহনবাগান। বিপক্ষের গোলকিপার মিরশাদের একটি মিসকিক থেকে বল পেয়ে রয় কৃষ্ণা বক্সের বাইরে ডানদিক থেকে লম্বা হাওয়ায় ভাসানো সেন্টার করেন বক্সের মধ্যে বাঁ দিকে থাকা অরক্ষিত কোলাসোকে। মাপা কোণাকুনি হেডে বল জালে জড়িয়ে দিতে ভুল করেননি তিনি। দ্বিতীয় পোস্টের ওপরের কোণ দিয়ে বল ঢুকে যায় গোলে। চলতি লিগে চতুর্থ গোলটি করে ম্যাচের সেরার পুরস্কারও তিনিই পান।
সেই পুরস্কার নিয়ে কোলাসো বলেন, “আমার প্রথম ম্যাচের সেরার পুরস্কারটা দের সতীর্থদের উৎসর্গ করতে চাই”। যথার্থ টিমম্যান হিসেবে যে তিনি নিজেকে তৈরি করে ফেলেছেন, তা তাঁর এই কথাতেই স্পষ্ট। তিনি বলেন, “শুধু একটা গোল করে বা ম্যাচের সেরার পুরস্কার পেয়ে তৃপ্তি পাইনা আমি। কারণ, আমি নিজে এবং দল এবার অনেক গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেছি। আরও বেশি গোল করতে পারতাম আমরা। গোল খেয়েওছি। এটা মোটেই ভাল নয়।”
এই ম্যাচের আগে টানা চারটি ম্যাচে জয়হীন ছিল কোলাসোর দল এটিকে মোহনবাগান। টানা চার ম্যাচে জয়হীন থাকার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। সেই চাপ নিয়েই যে গত ম্যাচে খেলতে নেমেছিলেন তাঁরা, তা স্বীকার করে কোলাসো বলেন, “পরপর কয়েকটা ম্যাচে পয়েন্ট খুইয়ে আমাদের ড্রেসিং রুম বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে নিজেদের বার করে আনতে পারলাম এই ম্যাচ জিতে। এ বার আমাদের সামনে তাকানোর পালা। গত ম্যাচে আমাদের নতুন কোচ কৌশলে কিছু পরিবর্তন করেছিলেন, যার কিছুটা আমরা বাস্তবায়িত করতে পেরেছি।”
গোয়ার ছেলে। ফুটবল পাগল রাজ্যে ফুটবল খেলে বড় হয়েছেন। খেলেছেন এফসি গোয়ার হয়েও। এখন ক্রমশ ভারতের এক নম্বর ফরোয়ার্ড হওয়ার জন্য লড়াই করছেন। তবে তা গোয়ার দলের হয়ে নয়, এক ফুটবল-আবেগে ভাসা রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী সবুজ-মেরুন বাহিনীর হয়ে। এই জায়গায় এসে এবার এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে মাঠে নামবেন কোলাসো। নিজের জন্মভূমির দলের বিরুদ্ধে গোল করার জন্য ও নিজেকে মেলে ধরার জন্য ছটফট করছেন লিস্টন কোলাসো।
এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, “এই ম্যাচের আগে কিছুটা সময় পাচ্ছি। এফসি গোয়ার হয়ে এক সময়ে খেলতাম। ওদের বিরুদ্ধে গোল করতে হবে। আমার বাবা-মা-ও চান আমি গোয়ার দলের বিরুদ্ধে গোল করি। বাবা মা-র ইচ্ছাপূরণের জন্য আরও গোল করতে হবে আমাকে। খুব চেষ্টা করব। রয় কৃষ্ণা ও হুগো বুমৌসের কাছ থেকে ভাল ভাল পাস পাচ্ছি। ওদের সঙ্গে খেলাটা খুব উপভোগ করছি।”
এতদিন সেভাবে যোগ্য সঙ্গত না পাওয়ার জন্যই হয়তো নিজেকে মেলে ধেরতে পারেননি কোলাসো। গতবার তাঁর গোল কনভারশন রেট ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অর্থাৎ যতগুলি শট গোলে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ গোলে পরিণত করতে পেরেছিলেন। এবার সেই হিসেবটা দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশ।
গতবার তিনটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন কোলাসো। এবার এখন পর্যন্ত করেছেন একটি। গতবার তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল ৪৫.২৯%। এ বার সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ শতাংশ। অর্থাৎ, নিজেকে অনেক উন্নত করে তুলেছেন কোলাসো। আর তাঁর এই উন্নতিতে প্রাক্তন কোচ হাবাসের অবদান অনস্বীকার্য। এখন তিনি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। বাঁ দিকের উইং বরাবর খেলে নিজেকে অনেক কার্যকরী করে তুলেছেন এই ‘নতুন’ কোলাসো।
হাবাসের পরে আর এক স্প্যনিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো এফসি গোয়ার দায়িত্ব ছেড়ে তাঁদের শিবিরে যোগ দেন। গত ম্যাচে তিনি ডাগ আউটে থাকলেও তার আগে দল নিয়ে অনুশীলনের মাঠে নামার সুযোগ পাননি তিনি। এ বার প্রাক্তন দল এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়েই এটিকে মোহনবাগানে অভিযান শুরু করছেন ফেরান্দো। যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এফসি গোয়াকে হারাতে পারাটা যেমন ফেরান্দোর মান-ইজ্জতের ব্যাপার, তেমনই কোলাসোরও। বুধবারের ম্যাচটা তাই দু’জনের কাছেই বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন কোচ তাঁকে কী ভাবে কাজে লাগান আর কোলাসো নতুন কোচের পরিকল্পনা কী ভাবে বাস্তবায়িত করেন, সেটাই হবে এই ম্যাচের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়।