জুলাই 27, 2024
Latest:
ফিচারস্বাস্থ্য

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা কি? কিভাবে এই সমস্যা থেকে বেরোবেন?

ড. চন্দন রায়

পরিবারে নতুন অতিথির আগমন পরিবারের সকল সদস্যের কাছে একটা বড় আনন্দের বিষয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়েরা প্রসূতি পরবর্তী বিষন্নতার শিকার হন। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর মায়েদের শারীরিক ও মানসিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। সন্তান জন্মানোর পর পরিবারের সকলেই সন্তানকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে সন্তানের মায়ের প্রতি কারোরই খেয়াল থাকে না। হরমোনাল পরিবর্তনের কারনে অধিকাংশ মায়েদের মধ্যে চরম হতাশা, দুঃখবোধ, উৎকন্ঠা দেখা দেয়। মায়েরা এইসময় অতিমাত্রিক আবেগপ্রবনও হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় সন্তান সামলাতে গিয়ে মায়েরা হিমশিম হয়ে পড়েন, গ্রাস করে চরম অসহায়তা। এই হতাশা থেকে তীব্র মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা নামে পরিচিত। যদি এই ধরনের বিষন্নতা কয়েকদিন স্থায়ী হয় তাহলে সেটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই বিবেচিত হয়। কিন্তু যদি এইপ্রকার বিষন্নতা কয়েকসপ্তাহ অবধি স্থায়ী হয় তাহলে সেক্ষেত্রে মায়েদের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। যদিও প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা শিশুর ৭-৮ মাস বয়সের পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই কমতে থাকে, কিন্তু অনেক মায়েদের ক্ষেত্রে এই বিষন্নতা দীর্ঘদিন ধরে থেকে যেতে পারে। ওয়েবএমডির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ধরনের বিষন্নতা সন্তান জন্মদানের চার সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়। যদিও এটির কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। সন্তান জন্মানোর পর অনেক মায়েদের পর্যাপ্ত পরিমানে বুকের দুধ উৎপন্ন হয় না – এটি নিয়ে মায়েদের মধ্যে চরম উৎকন্ঠা দেখা যায়। মা তার বাচ্চাকে ফর্মুলা মিল্ক খাওয়াবে কিনা বা কতটা খাওয়াবে, বাচ্চা কান্নাকাটি করলে কি করে বাচ্চার কান্না থামাবে, বাচ্চার ওজন ঠিকমতো বাড়ছে কিনা, কোনটা বাচ্চার খিদে পাওয়ার কান্না, কোনটা ঘুম পাওয়ার কান্না, কোনটা পেট ব্যথার কান্না – এসব নানা বিষয় নিয়ে মা অতিচিন্তিত হয়ে পড়ে। মায়ের বুকের দুধ ঠিকমত ক্ষরিত না হলে অনেক মা-ই বাড়ির পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খোঁটা শোনার ভয়ে লুকিয়ে তার বাচ্চাকে ফর্মুলা মিল্ক খাওয়ান। আজ ডিজিটাল ইন্ডিয়ার যুগে এখনও অনেক বাড়ি থেকে সন্তানের মা-কে একথা শুনতে হয় যে বাচ্চা কাঁদলে তার মা-কেই সেই কান্না থামাতে হবে অর্থাৎ পরিবারের কেউই সেক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে না। প্রসব পরবর্তী মায়েদের একদিকে হরমোনাল পরিবর্তন আর একদিকে পারিবারিক এইসব সমস্যার কারনে তারা জেরবার হয়ে পড়েন। তবে এটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ডিপ্রেশনের ধরন অনুযায়ী এর চিকিৎসা রয়েছে।ওষুধ এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক যে পরিবর্তন ঘটে, তা হরমোন দ্রুত কমে যাওয়ার জন্য হতে পারে। তবে হরমোন কমে যাওয়া এবং হতাশার প্রকৃত যোগসূত্র এখনও অবধি পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। নারীদের প্রজননের জন্য ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোন রয়েছে, গর্ভাবস্থায় যা ১০ গুণ বেড়ে যায়। সন্তান প্রসবের পর সেটি খুব দ্রুত কমে যায়।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষ্মণ কী?
পোস্টপার্টামডিপ্রেশনের কিছু লক্ষণ হলো–
১। অকারনে মনখারাপ বা কান্না পাওয়া
২। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া
৩। অস্থিরতা বা মুড সুইং
৪। খাবারের প্রতি অনীহা বা অতিরিক্ত খাওয়া এবং তীব্র ক্লান্তি
৫। হতাশায় ডুবে থাকা
৬। নিজেকে অসহায় লাগা
৭। কোনো কাজে অনুপ্রেরণা না পাওয়া
৮। কোনো কাজে আগ্রহ হারানো
৯। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা
১০। নিজেকে বা নিজের সন্তানকে আঘাত করার চিন্তা
১১। মাঝে মাঝে নিজের সন্তানকে অন্যের সন্তান মনে হওয়া
১২। নিজেকে খারাপ ভাবা বা হীনমন্যতায় ভোগা
১৩। স্মৃতির সমস্যা
১৪। যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া
বিষন্নতার প্রবনতা খুব বেশি হলে মা-এর মনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও আসতে পারে।
চিকিৎসা
প্রসব-পরবর্তী বিষন্নতায় আক্রান্ত মা-কে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসক রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা করবেন। অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি বা অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ, সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং – এগুলোই এই রোগের মূল চিকিৎসা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবারের লোকেদের মানসিক সাপোর্ট। সন্তানের খেয়াল রাখার পাশাপাশি সন্তানের মায়েরও যত্ন নিতে হবে। এটা কখনোই ভাববেন না যে সন্তানকে বড় করার জন্য মা-কেই দায়িত্ব পালন করতে হবে, পরিবারের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সন্তান এবং মা দুজনেই সুরক্ষিত থাকবে।

(লেখক বহরমপুর গার্লস কলেজের শারীরবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক। প্রবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।)