ক্রীড়া

ফের টানটান ট্রাইবেকারে কুয়েতকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন ভারত

এনএফবি, স্পোর্টস ডেস্কঃ

ফের এক টানটান উত্তেজনায় ঠাসা ১২০ মিনিটের ফুটবল-যুদ্ধ। ফের ততোধিক উত্তেজনায় পরিপূর্ণ পেনাল্টি শুট আউট এবং সাডেন ডেথের প্রথম শটই বাঁ দিকে ডাইভ দিয়ে বাঁচিয়ে ভারতকে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের খেতাব এনে দিলেন গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধু। এই নিয়ে ন’বার, টানা দ্বিতীয়বার।

মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে আল খলদি ও লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের গোলে নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময় ১-১ থাকার পর ম্যাচ গড়ায় টাই ব্রেকারে। রাত সোয়া দশটাতেও কান্তিরাভার গ্যালারিতে থাকা পঁচিশ হাজারেরও বেশি সমর্থকের চিৎকারে তখন গমগম করছে রাতের বেঙ্গালুরু।

পেনাল্টি শুট আউটে শুরুতেই ভারতীয় অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীর শট পোস্টে লেগে গোলে ঢুকে যায়। এর পরই কুয়েতের মহম্মদ আবদুল্লাহর শট গুরপ্রীতের হাতে লেগে বারের ওপরে লেগে বেরিয়ে যায়। ভারতের পক্ষে পরপর গোল করেন সন্দেশ ঝিঙ্গন ও লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে। কুয়েতের আল ওতাইবি ও আল ধাফেরিও জালে বল জড়িয়ে দেন। সমর্থকেরা যখন টাই ব্রেকারে জয়ের সেলিব্রেশন শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই সারা স্টেডিয়ামকে কার্যত স্তব্ধ করে দিয়ে উদান্ত সিং বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন। কুয়েতের আব্দুল মারান, ও আল খালদি এর পরের দুটি শটে গোল করায় উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। ভারতের পক্ষে শেষ শট নিতে যান অভিজ্ঞ বঙ্গ ডিফেন্ডার শুভাশিস বোস। তিনিও সফল হন।

পাঁচটি করে শটের পর ৪-৪ থেকে যাওয়ায় ম্যাচ গড়ায় সাডেন ডেথে। প্রথম শটে কোনও ভুল করেননি নাওরেম মহেশ সিং। কিন্তু কুয়েতের অধিনায়ক এল এব্রাহিম হাজিয়ার শট বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভ করে শেষ রাতে ওস্তাদের মার দেখান বহু যুদ্ধের নায়ক গুরপ্রীত সিং।

ম্যাচের শেষে টিভি সাক্ষাৎকারে গুরপ্রীত বলেন, “গোল খাওয়ার পরেও যে হাল ছেড়ে দেয়নি দলের ছেলেরা, সেজন্য পুরো কৃতিত্ব ওদের প্রাপ্য। কারণ, সারা ম্যাচে এই এক মুহূর্তেই দূর্বল হয়ে পড়ি আমরা। কুয়েতও নিজেদের লক্ষ্য থেকে একটুও নড়েনি। তবে ম্যাচ পেনাল্টিতে চলে গেলে যে কোনও দলই জিততে পারে। তবে আজকের দিনটা ছিল আমাদের”।

খেতাব জয়ের পরেই স্টেডিয়ামের পঁচিশ হাজার দর্শক যখন সমবেত ভাবে ‘বন্দেমাতরম’ গাইতে শুরু করে, তখন সুনীল ছেত্রী তাঁর দলবল নিয়ে ভিক্ট্রি ল্যাপ দিচ্ছিলেন। ভারতীয় ফুটবলে এমন দৃশ্য সত্যিই বিরল। ভারতীয় দলের ফুটবলাররা সকলে মিলে কুয়েতের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে ‘গার্ড অফ অনর’ দিতেও ভোলেননি। কয়েকদিন আগেই ভারত ভুবনেশ্বরে কন্টিনেন্টাল কাপ জিতে এসেছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালীন ফিফার ক্রমতালিকায় সেরা একশোতেও ফিরে এসেছে তারা। এ বার কুয়েতকে হারিয়ে নবমবারের জন্য সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ভারত হয়তো ক্রমতালিকায় আরও দু-একধাপ ওপরে উঠবে।

এই সাফল্যের পরে অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী টিভিতে বলেন, “এই জয়ে শুধু আমরা (ফুটবলাররা) নই, স্টেডিয়ামে উপস্থিত সবাই জড়িতে রয়েছেন, সেই জন্যই আরও ভাল লাগছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে ওরা (কুয়েত) মোটেই সোজা ছিল না। তবে আমরা যে এ ভাবে টুর্নামেন্টটা শেষ করতে পারলাম, সে জন্য আমি খুবই খুশি”। সারা টুর্নামেন্টে মোট ছ’গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও জিতে নেন সুনীল।

ভারত এই নিয়ে ন’বার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরার শিরোপা অর্জন করল। এর আগে ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ এবং ২০০৯ ও ২০১১-য় টানা দু’বার সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এই নিয়ে তৃতীয়বার তারা টানা দ্বিতীয়বার সাফ-সেরার খেতাব পেল।

সেমিফাইনালের দলে তিনটি পরিবর্তন করে এ দিন প্রথম এগারো নামায় ভারত। দুই ফুল ব্যাক নিখিল পূজারি ও আকাশ মিশ্র দলে ফিরে আসেন এবং মেহতাব সিংয়ের জায়গায় ফিরে আসেন সন্দেশ ঝিঙ্গন। মাঝমাঠ ও আক্রমণে কোনও পরিবর্তন হয়নি এ দিন। ৪-২-৩-১-এ খেলা শুরু করে দুই দলই। কুয়েত আল খালদিকে সামনে রেখে দল সাজায়। তাঁর পিছনে ছিলেন আল ফানেনি, আল ধাফেরি ও মহহম্মদ আবদুল্লা।

এ দিন শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার পরিকল্পনা নিয়েই নেমেছিল কুয়েত। ভারতীয় রক্ষণকে সমানে চাপে রেখে তাদের ভুল করতে বাধ্য করবে, এই কৌশলেই শুরু করে কুয়েত। তাদের কৌশল ক্লিক কাজে লেগে যায় ১৫ মিনিটের মাথাতেই। যখন মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা একটি বলে শুরু হওয়া আক্রমণকে গোলে পরিণত করেন আল খালদি।

উড়ে আসা বল নিয়ে ডানদিক দিয়ে আল ফানেনি সামনে পাস বাড়ান আল ব্লৌশিকে, যিনি গোলের সামনে ক্রস বাড়ান যখন, তখন সেখানে আল খালদি ছিলেন সম্পুর্ণ অরক্ষিত। এই ভুলেরই মাশুল দিতে হয় ভারতকে। গোলে বল ঠেলতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি কুয়েতি সেন্টার ফরোয়ার্ড (১-০)।

গোল খাওয়ার পেরেই তেড়েফুঁড়ে ওঠে ভারত এবং ১৬ মিনিটের মাথাতেই গোল শোধ করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান সুনীল ছেত্রী। বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের শট গোলকিপার আব্দুলরহমান মারজুকের হাতে লেগে সামনে ছিটকে আসে। সুনীল সেই বলে টোকা দিতে পারলে হয়তো গোল হত। কিন্তু খালেদ হাজিয়া তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে টাচ লাইনের বাইরে পাঠিয়ে দেন।

কুয়েতও ব্যবধান বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে জিকসন সিংকে কিছুটা নেমে আসতে হয় একজন বাড়তি সেন্টার ব্যাকের ভূমিকা পালন করার জন্য। ক্রমশ মাঠের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং দুই দলেরই ফুটবলাররা একে অপরের সঙ্গে অবাঞ্ছিত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। এর মধ্যে সন্দেশ ঝিঙ্গন ফের হলুদ কার্ড দেখেন। কার্ড সমস্যার জন্যই গত ম্যাচে খেলতে পারেননি তিনি। এ দিন আবার কুয়েতের ফ্রিকিকের সময় আল হারবিকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন তিনি। প্রতিপক্ষের আক্রমণ আটকাতে গিয়ে ৩৫ মিনিটের মাথায় গুরুতর চোট পান আনোয়ার আলি। তাঁকে স্ট্রেচারে শুইয়ে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁর পরিবর্তে নামেন মেহতাব সিং।

কুয়েতের ঘনঘন আক্রমণ সামলেও ভারতের সমতা আনার মরিয়া চেষ্টা অবশ্য থামেনি। কান্তিরাভার গ্যালারিতে থাকা পঁচিশ হাজারেরও বেশি সমর্থকের শব্দব্রহ্ম ছিল তাদের প্ররণা। ৩৮ মিনিটের মাথায় এমনই এক আক্রমণে সাফল্য পেয়ে যায় ভারত।

আল ধাফরির মিসক্লিয়ারেন্স থেকে বল পেয়ে বাঁ দিকের উইং থেকে বল টেনে এনে বক্সের সামনে সুনীলকে দেন আশিক। সুনীলের সিঙ্গল টাচে বক্সের মধ্যে বল পেয়ে যান সহাল, তিনি সময় নষ্ট না করে ডানদিকে গোলের সামনে বল ঠেলে দেন ছাঙতের উদ্দেশ্যে। সামনে ফাঁকা গোল পেয়ে সেখানে বল ঠেলতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ছাঙতে (১-১)। যেন কিছুক্ষণ আগেই অনুশীলন করে এসে গোলটি সাজান তাঁরা, এমনই মনে হচ্ছিল।

ভারত গোল পেতেই কুয়েতিরা আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। এই সময়ে যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে না যায়, তাই রেফারিকে কুয়েতের আবুজাবারাহকে হলুদ কার্ড দেখাতে হয়। ৪৩ মিনিটের মাথায় ভারতের বক্সের কাছে পাওয়া ফ্রি কিক থেকে সোজা গোলে বল রাখেন আল ধাফরি। কিন্তু তা পাঞ্চ করে বার করে দেন গোলকিপার গুরপ্রীত।

উত্তেজনা এতটাই ছিল যে বিরতির ঠিক আগে বাড়তি সময়ে পরপর তিনবার হলুদ কার্ড বার করেন রেফারি। আল ব্লৌশি ও আল ধাফরিকে হলুদ কার্ড দেখানোর কয়েক সেকেন্ড পরে তাদের সহকারী কোচকেও হলুদ কার্ড দেখানো হয়।

দাপুটে ফুটবল দিয়ে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে ভারতই। ৪৭ মিনিটের মাথায় ডানদিক থেকে নিখিলের মাপা ক্রস সুনীলের পায়ে পৌঁছনোর আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দখল নিয়ে নেন কুয়েতি গোলকিপার মারজুক। প্রতি আক্রমণের সুযোগের অপেক্ষায় থাকা কুয়েতও দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে একাধিক আক্রমণ হানলেও ঝিঙ্গনের রক্ষণ-বাহিনী তাদের রোখার জন্য সবসময়ই তৎপর ছিল।

ম্যাচের বয়স যখন এক ঘণ্টার কাছাকাছি, তখন পরপর কয়েকটি আক্রমণে কুয়েতের ডিফেন্সকে ব্যস্ত করে তোলে ভারত। কিন্তু প্রতিবারই গোলকিপার মারজুক তাদের বাঁচিয়ে দেয়। এই সময়ে মাঝমাঠে পিছন থেকে সুনীল ছেত্রীর জার্সি টেনে ধরে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার অপরাধে হলুদ কার্ড দেখেন মহম্মদ আবদুল্লাহ। এই নিয়ে পঞ্চম হলুদ কার্ড দেখেন কুয়েতের ফুটবলাররা।

উইং দিয়ে আক্রমণের ধার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ৭১ মিনিটের নাওরেম মহেশ সিংকে নামানো হয় অনিরুদ্ধ থাপার জায়গায়। আশিক কুরুনিয়ানের জায়গায় নামেন রোহিত কুমার। কিন্তু মাঠে নামার দু’মিনিটের মধ্যেই সুলতান আলেনেইজের সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ের সময় মেজাজ হারিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন রোহিত।

শেষ ১৫ মিনিটে দুই দলই প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় ঢোকার মরিয়া চেষ্টা চালালেও দু’পক্ষের রক্ষণের দুর্ভেদ্য দেওয়ালেই আটকে যায়। ভারতের বক্সের সামনে থেকে এই সময়ে দু’বার ফ্রি কিক পেলেও কোনওটিই কাজে লাগাতে পারেনি পশ্চিম এশীয় ফুটবলাররা। নির্ধারিত সময়ের একেবারে শেষে সহালের জায়গায় উদান্ত সিং নামেন। অতিরিক্ত সময়ের কথা ভেবেই সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ার্ধের বাড়তি পাঁচ মিনিটের শেষ দিকে মহেশের পাস থেকে গোলের সামনে ক্রস দেন রোহিত। কিন্তু সেখানে গোলে বল ঠেলার মতো কোনও খেলোয়াড় ছিল না ভারতের। পরের মিনিটেই ছাঙতে কাট ব্যাক করে বক্সের মধ্যে উদান্তকে গোলের পাস দিলেও তিনি ব্যালান্স হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ফলে ১-১ অবস্থাতেই অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় ম্যাচ।

অতিরিক্ত সময়ের শুরু থেকেই গতি এতটুকু কমেনি দুই দলের খেলায়। ৯৩ মিনিটের মাথায় আলফাহাদের অসাধারণ ব্যাকহিলে পাওয়া বল নিয়ে ডান উইং দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন আল রশিদি। কিন্তু মহেশ দুর্দান্ত ইন্টারসেপ্ট করায় সে যাত্রা বেঁচে যায় ভারত। ১১৫ মিনিটের মাথায় ভারতের বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নেন আবদুল্লাহ, যা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল করেন গুরপ্রীত।

অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলেরই ফুটবলারদের দেখে বোঝা যায় ক্লান্তি ক্রমশ ঘিরে ধরছে তাদের। কুয়েতের একাধিক ফুটবলারের পেশীতে টান ধরে। আকাশ মিশ্রও একবার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু চিকিৎসার পরে উঠে দাঁড়ান। তবে বেশিক্ষণ মাঠে থাকতে পারেননি তিনি। ১১৩ মিনিটের মাথায় তাঁর জায়গায় নামেন শুভাশিস বোস।

অতিরিক্ত সময় শেষ হওয়ার মিনিট দুয়েক আগে গোলের যে সুযোগ পান ছাঙতে, তা কাজে লাগাতে পারলে ওখানেই ম্যাচ জিতে নিতে পারত ভারত। একাধিক ডিফেন্ডারকে এড়িয়ে ডানদিক দিয়ে বল নিয়ে উঠে বক্সের মধ্যে ছাঙতেকে মাপা সেন্টার করেন নিখিল। ছাঙতে পা দিয়ে বল নামিয়ে গোলে শট নেন, যা বারের সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে যায়। এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পরে পেনাল্টি শুট আউটে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।