অঞ্জন চ্যাটার্জী, এনএফবিঃ
কোলাসোর গোল ও হুয়ান ফেরান্দোর মস্তিষ্কপ্রসূত কৌশল— বুধবার ফতোরদায় এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে এটিকে মোহনবাগানের বাজিমাত করার নেপথ্যে মূল দু’টি কারণ এগুলিই। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এদিন এফসি গোয়ার প্রাক্তনিদের কাছেই হেরে গেল এফসি গোয়া। বাড়তি পাওনা রয় কৃষ্ণার গোলে ফেরা। পাঁচ ম্যাচ পর ওপেন প্লে থেকে গোল পেলেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর ‘গোলমেশিন’। ম্যাচের শেষ দিকে একটি গোল শোধ করেন জর্জ ওর্টিজ, সৌজন্যে অমরিন্দর সিংয়ের অপ্রত্যাশিত ভুল। না হলে হয়তো লিগের দ্বিতীয় ‘ক্লিন শিট’ নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারত এটিকে মোহনবাগান। কিন্তু ২-১-এ জেতে গতবারের রানার্স আপ-রা।
নতুন কোচের অধীনে প্রথম ম্যাচ খেলা এটিকে মোহনবাগান এ দিন বল পজেশন বাড়িয়ে আক্রমণে ওঠার দিকে বেশি নজর দেয়। তবে ম্যাচের শেষে কোনওটিতেই জিততে পারেনি তারা (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন)। পজেশন ও গোলে শটের দিক থেকে এফসি গোয়াই এগিয়ে ছিল। কিন্তু যেটা সবচেয়ে জরুরি, সেই বেশি গোল তুলে নেয় এটিকে মোহনবাগান। এই জয়ের ফলে সেরা চারে ফিরে এল এটিকে মোহনবাগান। আট ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে তারা এখন তিন নম্বরে। মুম্বই সিটি এফসি (১৬) ও হায়দরাবাদ এফসি-র (১৫) পরেই। তবে এই হারে এফসি গোয়ার অবস্থানে পরিবর্তন হল না। তারা আটেই রয়ে গেল।
২৩ মিনিটঃ কোলাসোর গোল। মাঝমাঠে দীপক টাঙরির পাসে বাঁ দিকের উইংয়েই বল পান কোলাসো। বিপক্ষের বক্সের সামনে থেকে তাঁর ‘বানানা কিক’-এ জালে জড়িয়ে যায়।
৫৬ মিনিটঃ ২-০। ডানদিক থেকে কর্নারে উড়ে আসা বলে বক্সের সামনের ভাগে অরক্ষিত থাকা রয় কৃষ্ণা বুলেট-গতির শটে গোল পেয়ে যান।
৮১ মিনিটঃ ২-১। বক্সের মাথা থেকে গোলমুখী জোরালো শট নেন জর্জ ওর্টিজ, তা অমরিন্দরের হাত ফস্কে গোললাইন পেরিয়ে জালে জড়িয়ে যায়।
গত ম্যাচের দলে কোনও পরিবর্তন না করে এ দিন ৪-২-৩-১-এ দল সাজান এটিকে মোহনবাগানের নতুন কোচ হুয়ান ফেরান্দো। তাঁর সদ্য প্রাক্তন ক্লাবের বিরুদ্ধে ম্যাচে যে শুরুতেই গোল তুলে নেওয়াটা উদ্দেশ্য ছিল তাঁর, তা এই ছকে দল সাজানো দেখেই আন্দাজ করা যায়।
আক্রমণাত্মক ছকে দল সাজালেও শুরুতে কিন্তু এফসি গোয়াই তাদের চাপে রাখে। প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই দু’টি সুযোগ তৈরি করে নেন মহম্মদ নেমিল ও দেবেন্দ্র মুরগাঁওকর। প্রথমজন গোলের বাইরে মারেন ও পরেরজন সোজা গোলকিপারের গ্লাভসে। তবে ক্রমশ বল পজেশন বাড়িয়ে খেলা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চলে আসার চেষ্টা শুরু করে এটিকে মোহনবাগান।
এফসি গোয়ার আক্রমণের প্রবণতা কমলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নগুয়েরা, ওর্টিজরা। এ দিন এডু বেদিয়াকে ছাড়াই খেলতে নামে এফসি গোয়া। নেমিল কুড়ি মিনিটের মাথায় ফের গোলের দিকে শট নেন, কিন্তু তা বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। এর তিন মিনিট পরেই এফসি গোয়াকে নিজেদের এলাকায় টেনে আনার পরে দ্রুত প্রতি আক্রমণে ওঠে সবুজ-মেরুন শিবির এবং গোলও পেয়ে যায় তারা।
২৩ মিনিটের মাথায় চলতি হিরো আইএসএলের পঞ্চম গোলটি পেয়ে যান লিস্টন কোলাসো। প্রতি ম্যাচের মতোই বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণে উঠছিলেন তিনি। এই গোলের ক্ষেত্রেও মাঝমাঠে দীপক টাঙরির পাসে বাঁ দিকের উইংয়েই বল পান তিনি। কোণাকুণি কিছুটা এগিয়ে বিপক্ষের বক্সের সামনে থেকে সোজা গোলের উদ্দেশ্যে ‘বানানা কিক’ নেন এবং লাফিয়ে ওঠা গোলকিপার ধীরজ সিংয়ের মাথার ওপর দিয়ে তা সোজা জালে জড়িয়ে যায়। এ রকম গোল এর আগেও করতে দেখা গিয়েছে কোলাসোকে। আগের দিন বলেছিলেন, বাবা-মায়ের ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রাক্তন ক্লাবের বিরুদ্ধে গোল করতে চান এবং সেই স্বপ্নের গোলটি পেয়েও গেলেন তিনি।
গোল খাওয়ার পরে তা শোধ করার জন্য আরও মরিয়া হয়ে ওঠে এফসি গোয়া। ৩০ মিনিটের মাথায় বক্সের বাঁ দিক থেকে ফ্রি কিকে দুর্দান্ত এক গোলের শট নেন জর্জ ওর্টিজ। কিন্তু অমরিন্দর ডানদিকে ডাইভ দিয়ে তা আটকে দেন। বাঁ দিকের উইং দিয়ে গোয়ার ফুটবলাররা বারবার আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করলেও সবুজ-মেরুন ডিফেন্ডাররা বারবার তাঁদের আটকে দেন। ৪০ মিনিটের মাথায় চোট পেয়ে মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য হন শুভাশিস। তাঁর জায়গায় নামেন প্রবীর দাস। তিনি ডান উইংয়ে গিয়ে আশুতোষ মেহতাকে বাঁ দিকে পাঠিয়ে দেন।
প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে পরপর দু’বার গোলের সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া করেন মনবীর সিং। এই মরশুমে প্রায়ই এ ভাবে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই এফসি গোয়া বিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করলেও পজেশন বাড়িয়ে ফের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে নিয়ে আসে এটিকে মোহনবাগান এবং ধীরগতিতে আক্রমণও তৈরি করতে থাকে তারা। এমনই আক্রমণে পাওয়া কর্নার থেকে ৫৬ মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যান সবুজ-মেরুন শিবিরের ‘গোলমেশিন’ হিসেবে বিখ্যাত রয় কৃষ্ণা। ডানদিক থেকে কর্নারে উড়ে আসা বলে বক্সের সামনের ভাগে অরক্ষিত থাকা রয় ডান পায়ে বুলেট-গতির শটে গোল পেয়ে যান। সামনে বিপক্ষের ডিফেন্ডার দেবেন্দ্র থাকলেও ওই গতির বল তিনি আটকাতে পারেননি।
বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে পেনাল্টি থেকে গোল পেলেও ওপেন প্লে থেকে গোল পাচ্ছিলেন না ফিজিয়ান তারকা। সেই কলকাতা ডার্বিতে (২৭ নভেম্বর) শেষ ওপেন প্লে থেকে গোল পেয়েছিলেন তিনি। তার পরে পাঁচটি ম্যাচে একটি গোল করেন, তাও পেনাল্টি থেকে। এক মাস দু’দিন পরে বুধবার অবশেষে ফের তাঁর পায়ের জাদু দেখলেন সমর্থকেরা।
৬৯ মিনিটের মাথায় যেমন জোড়া পরিবর্তন করে এফসি গোয়া, তেমনই তার তিন মিনিট পরে এটিকে মোহনবাগানের ডাগ আউট থেকেও মাঠে নামেন দুই বিদেশি। জনি কাউকো নামেন হুগো বুমৌসের জায়গায় ও ডেভিড উইলিয়ামস নামেন রয় কৃষ্ণার জায়গায়। আক্রমণে গতি আনার জন্যই যে এই দুই পরিবর্তন ফেরান্দোর, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
আক্রমণে গতি আনার উদ্দেশ্যে পরিবর্তগুলি করলেও ৮০ মিনিটের মাথায় দেখা যায় সবুজ-মেরুন জার্সির আট-ন’জন খেলোয়াড় তাঁদের নিজেদের এলাকায়। এই অবস্থার মধ্যেও অবশ্য একটি গোল শোধ করে দেয় এফসি গোয়া। এই গোলের জন্য অবশ্য গোলকিপার অমরিন্দর সিংই মূলত দায়ী। বক্সের মাথা থেকে যে গোলমুখী জোরালো শট নিয়েছিলেন জর্জ ওর্টিজ, তা এই স্তরের যে কোনও গোলকিপারের পক্ষেই আটকানো খুব একটা কঠিন ছিল না। কিন্তু অমরিন্দরের হাত ফস্কে তা গোললাইন পেরিয়ে জালে জড়িয়ে যায়।
এ দিন ম্যাচ শুরুর পর থেকেই অমরিন্দরকে দেখে মনে হয়নি তিনি খুব একটা স্বচ্ছন্দে ছিলেন। বিরতির আগে মাঠের পাশে দলের অপর গোলকিপার অভিলাষ পালকেও ওয়ার্ম আপ করতে দেখা যায়। বিরতির পর তিনিই যে নামবেন, এমন প্রত্যাশাই ছিল। কিন্তু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও অমরিন্দর পুরো ম্যাচ খেলেন। তবে এই গোলের পরে আর কোনও বিপজ্জনক আক্রমণে উঠতে পারেনি এফসি গোয়া।