এনএফবি, স্পোর্টস ডেস্কঃ
টানা আট ম্যাচে গোল না খাওয়ার পর অবশেষে গোল খেল ভারত, তাও আত্মঘাতী গোল। মঙ্গলবার চলতি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে প্রায় জেতা ম্যাচ হাতছাড়া করে কুয়েতের বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে। প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে দুর্দান্ত গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ভারতীয় অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবধান বজায় রেখেছিল ভারত। কিন্তু ৯২ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষের আক্রমণ ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজেদের গোলেই বল ঠেলে দেন আনোয়ার আলি।
দুই দলের মধ্যে ফুটবল-দক্ষতার তুমুল লড়াইয়ের পাশাপাশি এ দিন একাধিকবার কান্তিরাভা স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় অশান্তির ঝড়ও ওঠে। অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে ভারতীয় দলের হেড কোচ ইগর সিটমাচকে ফের লাল কার্ড দেখে মাঠে ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। এই ম্যাচেই তিনি লাল কার্ডের সাসপেনশন কাটিয়ে মাঠে ফিরেছিলেন। কিন্তু ফের লাল কার্ড দেখায় এ বার ক’টি ম্যাচে তাঁকে মাঠের বাইরে থাকতে হবে, সেটাই দেখার। তবে সেমিফাইনালে যে তাঁর ভারতের ডাগ আউটে থাকা হচ্ছে না, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
শুধু কোচ নয়, ভারতীয় দলের তরুণ ফরোয়ার্ড বাংলার ফুটবলার রহিম আলিও শেষ দশ মিনিটের জন্য পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নেমে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। মেজাজ গরম করে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে ঠেলে ফেলে দেওয়ার অপরাধে লাল কার্ড দেখতে হয় তাঁকে। যাঁকে ঠেলে ফেলে দেন তিনি, সেই হামিদ আল কালাফকেও লাল কার্ড দেখান রেফারি। কারণ, তিনি বল কাড়তে গিয়ে অন্যায় ভাবে সহাল আব্দুল সামাদকে ঠেলে ফেলে দেন। তারই প্রতিবাদ করতে যান রহিম। এই ঝামেলার ফলে মনসংযোগে ব্যাঘ্যাত ঘটে এবং ভারতীয় রক্ষণের ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা নক্ষত্র আনোয়ার ভুল করে নিজের গোলের বল ঠেলে দেন।
ম্যাচের পরে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় অধিনায়ক ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৯২তম গোল করা সুনীল ছেত্রীকে আফসোস করতে শোনা যায়। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “ড্র হলেও মনে হচ্ছে যেন হেরে গিয়েছি। কারণ, আজ ভাল খেলেছি আমরা। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলাম না বলেই খুব খারাপ লাগছে। তবে এটাই ভাল যে, দুই দলই আমরা সেমিফাইনালে উঠেছি। এ বার আমাদের সেমিফাইনালে আরও কঠিন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে”।
এই ড্রয়ের ফলে ভারতের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠা হচ্ছে না। তাদের শেষ চারে যেতে হচ্ছে ‘এ’ গ্রুপের দ্বিতীয় সেরা দল হিসেবে। শীর্ষস্থানীয় দুই দলের অর্জিত পয়েন্ট (৭) ও গোলপার্থক্য (৬) সমান হলেও কুয়েত (৮) ভারতের (৭) চেয়ে একটি গোল বেশি করায় তারাই গ্রুপের সেরা হিসেবে শেষ চারে উঠল। এই গ্রুপের এক নম্বর দল সেমিফাইনালে ‘বি’ গ্রুপের দ্বিতীয় সেরার মুখোমুখি হবে। কোন দলের বিরুদ্ধে খেলতে হবে তাদের তা বুধবার এই গ্রুপের শেষ দুই ম্যাচের পর বোঝা যাবে।
‘বি’ গ্রুপের যা অবস্থা, তাতে বুধবার বড়সড় কোনও অঘটন না ঘটলে কুয়েতকে হয়তো খেলতে হবে বাংলাদেশ অথবা মলদ্বীপের বিরুদ্ধে। ভারতকে খেলতে হতে পারে লেবাননের বিরুদ্ধে, যাদের মুখোমুখি তারা সম্প্রতি হয়েছে দু-দু’বার। তবে সত্যিই এমনই লাইন-আপ দাঁড়ায় কি না, তা বোঝা যাবে বুধবার রাতে।
গত ম্যাচের দলে ছ’টি পরিবর্তন করে এ দিন দল নামান ইগর স্টিমাচ। সুনীল ছেত্রীকে বিশ্রাম দেওয়া হতে পারে, এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও এ দিন তাঁকেই সবার আগে অনুশীলনে নামতে দেখা যায় এবং প্রথম এগারোতেও ছিলেন তিনি।
এ দিন শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যায় ভারতের খেলায়। ছ’মিনিটের মাথাতেই বাঁ দিকের উইং থেকে আকাশ মিশ্রর ক্রসে গোলের সুযোগ পেয়ে যান সুনীল। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। ন’মিনিটের মাথায় ডানদিক থেকে নিখিলের ক্রস মহেশ সিংয়ের কাছে পৌঁছনো মাত্রই তা ইন্টারসেপ্ট করেন কুয়েতি ডিফেন্ডাররা। মহেশের কর্নার থেকে আনোয়ার আলি গোলে শট নিলেও তা ব্লক করা হয়।
থাপা, মহেশ, আশিকরা বাঁ দিকের উইংয়ে প্রায়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, যা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান কুয়েতের ডিফেন্ডাররা। তবে কুয়েতও প্রায়ই প্রতি আক্রমণে ওঠে, যা ভারতীয় রক্ষণকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। ২৫ মিনিটের মাথায় তাদের এমনই এক আক্রমণ থেকে পাওয়া সুবর্ণ সুযোগ বানচাল করে দেন গোলকিপার অমরিন্দর। সতীর্থের সঙ্গে ওয়াল খেলার পর মহম্মদ আবদুল্লা গোলমুখী জোরালো শট নিলে গোলে প্রবেশ করার আগেই তা আটকে দেন ভারতীয় গোলকিপার।
৩৩ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক থেকে গোলের সামনে আশিকের উদ্দেশ্যে অসাধারণ ক্রস দেন মহেশ, কিন্তু তা আশিকের কাছে পৌঁছনোর আগেই বল টাচ লাইনের বাইরে পাঠিয়ে দেন আল হারবি। কর্নার থেকে আনোয়ার আলি হেড করে গোলের চেষ্টা করলেও তা গোলের অনেক বাইরে দিয়ে চলে যায়।
প্রথমার্ধের একেবারে শেষে, স্টপেজ টাইমে, কাজের কাজটি করেন সেই সুনীল ছেত্রী। ডানদিক থেকে থাপার কর্নারে সাইড ভলি করে সোজা প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেন (১-০)। বক্সের সামনের দিকে ছিলেন সুনীল, যেখানে তাঁর জন্য কোনও মার্কিং ছিল না। প্রতিপক্ষের এই ভুলকেই কাজে লাগান ভারতীয় দলনেতা। তবে কৃতিত্ব অর্ধেক পাওনা থাপারও। যিনি সুনীলকে লক্ষ্য করে একেবারে সঠিক জায়গায় বল পাঠান।
দ্বিতীয়ার্ধেও একই গতিতে খেলা শুরু করে দুই দল। দু’পক্ষেরই প্রবণতা ছিল আগের মতোই। কেউই কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি ছিল না। আনোয়ার আলির হাতে বল লাগায় ৫৭ মিনিটের মাথায় ভারতের বক্সের সামনে ফ্রি কিক পায় কুয়েত। আবদুল্লার ফ্রিকিক বারের নীচ দিয়ে গোলে ঢোকার আগেই লাফিয়ে উঠে তা বের করে দেন অমরিন্দর।
এ দিনও ভারতীয় দলের কোচ বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে হলুদ কার্ড দেখেন। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেও তিনি লাল কার্ড দেখেছিলেন। এই ম্যাচেও মাঠ থেকে বল তুলে নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে ৮১ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখিয়ে তাঁকে বের করে দেন রেফারি। এই নিয়ে একই টুর্নামেন্টে পরপর দু’বার লাল কার্ড দেখেন ভারতীয় কোচ, যা মোটেই খুব একটা ভাল দৃষ্টান্ত নয়।
গতিময় ম্যাচে এ দিন প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন দুই দলের খেলোয়াড়রা। কিন্তু কোচেদেরও এর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। প্রথমার্ধে কুয়েতের সহকারী কোচকেও হলুদ কার্ড দেখতে হয় রেফারির সঙ্গে অযথা তর্ক করার জন্য। মঙ্গলবার ফের লাল কার্ড দেখায় স্টিমাচকে পরে ক’টি ম্যাচে মাঠের বাইরে থাকতে হয়, সেটাই দেখার।
ভারত ক্রমশ চাপ বাড়াতে থাকে এবং ৬৮ মিনিটের মাথায় সুনীলের শট জিকসন সিংয়ের গায়ে লেগে গোলের বাইরে গেলেও রেফারি ভারতকেই কর্নার দেন। কর্নার থেকে আনোয়ার হেড করলেও তা গোলের বাইরে চলে যায়। এর তিন মিনিট পরেই জিকসনের ফরোয়ার্ড পাস পেয়ে গোলে শট নেন আশিকের বদলে নামা সহাল আব্দুল সামাদ। কিন্তু তা ব্লক করে দেন আল ফানিনি।
এ দিন দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় রক্ষণকে আরও দুর্ভেদ্য লাগছিল। প্রথমার্ধে যাও বা কয়েকটি আক্রমণ ভারতীয় বক্সের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে কুয়েত, দ্বিতীয়ার্ধে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। যখনই আক্রমণে উঠেছে তারা, সন্দেশ ঝিঙ্গনের নেতৃত্বাধীন রক্ষণ বিভাগ সর্বশক্তি দিয়ে তাদের আটকে দেয়।
তবে ম্যাচের শেষ দিকে গোল শোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে কুয়েত এবং মিনিট তিনেকের মধ্যে দু’বার বাঁ দিক দিয়ে ভারতের বক্সে ঢুকে পড়েন শাবেইব আলখালদি। কিন্তু একবার তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেন আনোয়ার এবং পরেরবার অমরিন্দর তাঁর শট দুর্দান্ত সেভ করেন।
কিন্তু ম্যাচের একেবারে শেষে যে রকম অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে, তা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। সহাল আব্দুল সমাদকে আল কালাফ ঠেলে ফেলে দেওয়ায় রহিম আলি ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং আল কালাফকে সজোরে ঠেলে ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে দুই দলের খেলোয়াড়রা একে অপরের দিকে তেড়ে যান। রেফারি অবস্থা সামলান দুই ফুটবলারকেই লাল কার্ড দেখিয়ে।
এই ঝামেলার ফলে মনসংযোগে যে ব্যাঘ্যাত ঘটে, তারই মাশুল ভারতকে দিতে হয় স্টপেজ টাইমে কুয়তকে সমতা আনার গোল উপহার দিয়ে। নিজেদের গোলের অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজেদের গোলের জালেই বল জড়িয়ে দেন আনোয়ার (১-১)। এই গোল খাওয়ার পরেও উদান্ত সিং ডানদিক দিয়ে পরপর দু’টি আক্রমণ তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনও বারই গোলে শট নিতে পারেননি তিনি। আট মিনিটের বাড়তি সময় পেয়েও কোনও পক্ষ জয়সূচক গোল করতে পারেনি।